অন্নদাত্রী দেবীর আরাধনা
হিন্দু ধর্মে অসংখ্য দেবদেবীর উল্লেখ আছে। এর মধ্যে অন্নপূর্ণা অন্যতম। অন্ন দিয়ে যিনি সকলের দুঃখ, দারিদ্র্য দূর করেন তিনিই দেবী অন্নপূর্ণা। অন্নপূর্ণার এক হাতে অন্নপাত্র, আর অন্য হাতে দর্বি বা হাতা। তাঁর মাথায় নবচন্দ্র, একপাশে ভূমি ও অন্যপাশে শ্রী। দেবী পার্বতীরই আরেক রূপ হলেন অন্নপূর্ণা। তাঁর অপর নাম অন্নদা। দেবী পার্বতী ভিক্ষারত শিবকে অন্নপ্রদান করে এই নাম পান।
প্রতিটি উৎসবের কোনো না কোনো কাহিনি, তাৎপর্য, ইতিহাস আছে। অন্নপূর্ণা পূজারও আছে। পুরাণ মতে, চৈত্র মাসে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে কাশীতে আভির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী অন্নপূর্ণা। সেই সূত্রে এই তিথিতেই দেবীর বাৎসরিক পূজা হয়। অন্নপূর্ণাপূজা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল জমিদারমহলে ও ধনাঢ্য পরিবারে। এ অঞ্চলে অন্নপূর্ণা দেবীর পূজা সূচনা করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আগের রাজা ভবানন্দ মজুমদার। কথিত আছে যে, দেবী অন্নপূর্ণার কৃপা পেয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তিনি রাজা উপাধি লাভ করেন।
যদিও অন্নদামঙ্গল কাব্যে ভিন্ন গল্প বলা হয়েছে। অন্নদামঙ্গল মতে, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর কাছে নির্ধারিত দিনে কর বা রাজস্ব মেটাতে না পারার কারণে দুর্গাপূজা চলাকালীন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় মুর্শিদাবাদে কারারুদ্ধ হন। কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাদর্শন না হওয়ার কারণে, অন্নপূর্ণা দর্শন দিয়েছিলেন তাঁকে। সেই থেকে বাংলায় অন্নপূর্ণা বা অন্নদা পূজার সূত্রপাত বলে মনে করেন অনেকে।
অন্নপূর্ণা পূজা বাংলার একটি প্রাচীন পূজা। এই পূজা এসেছিল কাশী থেকে। বাংলার সঙ্গে কাশীর যোগ বহুকালের। তা ছাড়া তখন সীমান্তের কাঁটাতার ছিল না। পুরো ভারতবর্ষই ছিল একটি অভিন্ন দেশ। বাঙালির কাছে গয়া-কাশী-বৃন্দাবনের ভূমিকা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সেকালে অধিকাংশ ধার্মিক ধনাঢ্য পরিবারের বিধবারা কাশীবাসী হতেন। আর এই কাশী হলো মা অন্নপূর্ণার অধিষ্ঠানক্ষেত্র। শৈব ও শাক্ত-সংস্কৃতির অপূর্ব মিলনস্থল।
মার্কেণ্ডেয় পুরাণের কাশীখণ্ড দেবীভাগবতে ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে কাশীর অন্নপূর্ণা সম্পর্কে নানা উপাখ্যান রয়েছে। লোককাহিনি অনুসারে, শিব যোগীরাজ হলে কী হবে, আদতে ভিক্ষুক। রোজগারের মুরোদ নেই। রাজার দুলালী গৌরীর তাই একেবারে নাজেহাল অবস্থা। এই নিয়ে নিত্য শিব-দুর্গার কলহ চলত। ক্ষোভে দুঃখে গৌরী একদিন চলে গেলেন বাপের বাড়ি। জয়া-বিজয়া তাকে পরামর্শ দিলেন যে ভিখিরি শিবকে জব্দ করতে হবে। সেই অনুযায়ী দেবী জগতের সমস্ত অন্ন হরণ করলেন। শিব তখন খিদের চোটে নাকাল। যেখানেই যান ‘হা অন্ন, হা অন্ন’! শেষে লক্ষ্মীর পরামর্শে কাশীতে এলেন শিব। অন্নপুর্ণার হাত থেকে অন্ন খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। কাশীতে স্বয়ং মহাদেবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির। চৈত্র শুক্লাষ্টমীতিথিতে শুরু হলো দেবীর পূজা। এইভাবে কালক্রমে কাশীর দেবী অন্নপূর্ণা হয়ে উঠলেন বাঙালির ঘরের মেয়ে।
প্রশ্ন হলো, কাশীর আগে কি অন্নপূর্ণা দেবীর পূজা হতো না? বিশেষজ্ঞদের মতে, আসলে অন্নপূর্ণা এ অঞ্চলের শস্যদেবী। পেটের জ্বালা বড়ো জ্বালা। জনশ্রুতি হলো এই দেবীর পূজা করলে অন্নকষ্ট দূর হয়। তখনকার সমাজে মাঝে মাঝেই নেমে আসত আকাল বা দুর্ভিক্ষ। তার বলি হতো গরিব মানুষ। সুপ্রাচীন কাল থেকেই রাঢ় বাংলায় নবান্ন উৎসবের সময় এই অন্নপূর্ণার পূজা হয়ে আসছে। আজও গ্রামে গ্রামে নতুন ফসল তোলার পরই দেবীর হাতে ধানের পাকা শিষের গুচ্ছ দিয়ে পূজা হয়। কাশীর অন্নপূর্ণার সঙ্গে যার গভীর মিল রয়েছে। কাশীর মন্দিরেও শুধু পাকা ধানের গুচ্ছ বা শস্য দিয়ে দেবীর পূজা হয়। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে, দেবী অন্নপূর্ণা মূলত রাঢ়-বঙ্গের দেবী। এক সময় এই দেবীর পূজা কাশীতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাঙালিরাই।
আচার্য সুকুমার সেনের মতে, দেবী অন্নপূর্ণা গ্রিক ও রোমান দেবী ‘অন্নোনা’র রূপান্তর। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের রোম সম্রাট টিটাসের রাজত্বকালে্র একটি মুদ্রায় এই অন্নোনার মূর্তি খোদিত আছে। দেবীর বামহাতে শিঙ্গা আর ডানহাতে তুলাদণ্ড। অনেকেই অবশ্য আচার্য সেনের এই অভিমত মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের মতে এই শস্যদেবী আসলে শাকম্ভরীর মতো একান্তই ভারতীয় দেবী, যার উৎস রয়েছে হরপ্পা সভ্যতায়। এটি প্রাচীন পূজা যা পরবর্তীকালে কাশীতে অনুপ্রবেশ করেছিল প্রবাসী বাঙালিদের হাত ধরেই।
কথিত আছে, যে বাড়িতে মা অন্নপূর্ণার আশীর্বাদ থাকে, সেখানে কোনো ধরনের অভাব হয় না। মা অন্নপূর্ণার কৃপায় খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার পূর্ণ থাকে। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই এখনও ভক্তিভরে দেবী অন্নপূর্ণার পূজা করেন।
চিররঞ্জন সরকার: কলাম লেখক