সম্প্রীতির বন্ধনে দুর্গোৎসব
বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই তেরো পার্বণের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দমুখরভাবে উদ্যাপিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। সেই দুর্গোৎসব এখন চলমান।
ধনী-গরিব আর জাতি-ধর্মনির্বিশেষে এই উৎসবে শামিল হয় সবাই। ভুলে যায় বৈরিতা, ভুলে যায় শঠতা, ভুলে যায় উঁচু-নিচু বিভেদের প্রাচীর। শত নদীর স্রোতের মতো মিলিত হয় সাগরে, অর্থাৎ উৎসবের আনন্দে।
নদীর কূলে কাশফুলের নাচন, শিউলি ফুলের মাদকতা, নির্মেঘ আকাশের স্নিগ্ধ মায়াবী মাধবী চাঁদের আলো, শঙ্খের ধ্বনি, উলুধ্বনি, কাঁসরঘণ্টা, ঢাকের ঢ্যাং কুরা কুর আওয়াজ আর পুরোহিতের ভরাট কণ্ঠের চণ্ডীমন্ত্র উচ্চারণে মা বন্দিতা হন ধরাধামে।
মূলত মহালয়ার মাধ্যমেই দেবীরূপের শুরু, অর্থাৎ পূজার আনুষ্ঠানিকতা। তারপর দিন গুনতে গুনতে আসে পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী। দুর্গা মায়ের বিসর্জনের মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে পূজার আনুষ্ঠানিকতার।
দেবী দুর্গা মহাশক্তির প্রতীক। সেই মহাশক্তিকে প্রতিমার মধ্য দিয়ে চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তিকে দর্শন করাই দুর্গাপূজা। তাই এ পূজা প্রতিমাকে পূজা করা নয়, প্রতিমাতে পূজা করা।
যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, চিকের আড়ালে দেবী সব সময়ই রয়েছেন। চিকের আড়ালে যিনি আছেন, তিনি মহাশক্তি দেবী দুর্গা। শাকম্ভরী অবতারে তিনি দুর্গম নামের মহাসুরকে বধ করে দুর্গা নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। আবার ভক্তদের অনুভবে ‘চিকের’ আড়ালে থাকা মহাশক্তি ভক্তদের দুর্গতি নাশ করেন, তাই তিনি দুর্গা।
অশুভ শক্তিকে দমন করার জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব। পুরাণমতে, শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ,
চন্দ্রের তেজে সন্তানদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল।...মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ,
অগ্নি দিলেন শক্তি...[দ্র. হংস নারায়ণ,
(১৯৮০, ১৭৫)] এই হলো বিপদনাশিনী দেবী মাতা দুর্গা।
ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মন্দির প্রাঙ্গণে যেমন দর্শনার্থীদের ঢল দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় মন্দির ঘিরে রংবাহারি আলোকসজ্জা। মন্দির প্রাঙ্গণ আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে, যখন ধূপধুনো হাতে নাচের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে। অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে উলুধ্বনি দেওয়ারও প্রতিযোগিতা। এখানে জাতপাতের কোনো বিচার আগেও ছিল না, এখনো নেই।
দুর্গা মাকে দেখতে আসা দর্শনার্থীদের ঢলে শুধু যে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা থাকেন, তা কিন্তু নয়। সব ধর্মের মানুষই থাকেন।
হাতের পাঁচটি আঙুল কখনো সমান হয় না। মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। পশুত্ব আর মনুষ্যত্ব দিয়েই মানুষ। তাই কখনো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে অপ্রীতিকর কিছু ঘটনার কথা শোনা যায়। সে ঘটনার আইনি সুরাহাও হয়। তাই বলে তো উৎসব থেমে থাকতে পারে না।
সংখ্যালঘু শব্দটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। বাংলাদেশে আমি হিন্দু বলে কি সংখ্যালঘু? বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান বলে সে সংখ্যালঘু? মোটেও তা নয়। বাংলাদেশ আমার। এ দেশে আমার জন্ম। এ দেশে আমার বাবার জন্ম। এ দেশে আমার ঠাকুরদাদা জন্মগ্রহণ করেছেন। আমার বাবা যুদ্ধ করেছেন এ দেশের জন্য। তাহলে নিজের দেশে কেন আমি পরবাসী হব? কেন ভয় পাব আমারই মহল্লার আরেক ভাইকে? আমার কেন অধিকার থাকবে না? এ দেশ আমার ভিত। এ দেশ আমার মা। এই দেশ আমার মন্দির। এই দেশের মন্দিরেই হবে আনন্দ উৎসব, পূজাপার্বণ। এ দেশের এমনও জায়গা আছে, যেখানে এক পাশে মন্দির অন্য পাশে মসজিদ। আজান হচ্ছে মসজিদে, তারপরই
পূজার ঘণ্টা বেজে উঠছে। ধর্ম পালনে কেউ
কাউকে বাধা দিচ্ছে না। তাহলে কোথায় সম্প্রীতির অভাব!
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সাধুনাগ আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ