দুর্গা উৎসব
ভালোবাসা ব্যাপারটা মাটির হাঁড়িতে দই পাতার মতো। স্থিতি না এলে দুটির কোনোটাই জমে না।
মফস্সল অথবা প্রত্যন্ত গ্রামে মাটির প্রতিমা তৈরি হয় মণ্ডপের কাছাকাছি কোথাও। পুরোনো কোনো বাড়ির উঠানে হয়তো শুরু হয় প্রতিমা তৈরির জন্য বাঁশ ও খড় বাঁধার আয়োজন। নানা ছলে বহুবার ঘুরঘুর করা যায় সেখানে।
মাটির প্রথম প্রলেপের পর অস্পষ্ট আদলটা মনের ভেতর বুদ্বুদ তোলে—গতবারের চেয়ে এবার কতখানি ভিন্ন হবে সে!
এরপর মণ্ডপে অধিষ্ঠানের (স্থাপন) সময় দেবীর টানা চোখ, কোঁকড়া চুল আর গৌরবর্ণের ওপর পাটভাঙা শাড়ির কারুকাজে আরেক
বিস্ময়ের পালা। শক্তিদায়িনীর পরিপূর্ণ রূপে আসার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে চণ্ডীপাঠ, ঢাকের বাড়ি ও উলুধ্বনি।
ছন্দের মায়াজাল বুনে যায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনীর রেকর্ডের সুর। সব সময় ধূপধুনোর ঘ্রাণ হচ্ছে যুগলবন্দী উপচার। মহালয়া, বোধন ও সন্ধিপূজাকে কেন্দ্র করে জন্মানো সেই যুগলবন্দী সমানতালে পৌঁছে যায় পাড়ার উঁচু বাড়ি থেকে টিনের ঘর পর্যন্ত।
বেলপাতা ও ফুল সাজানো অথবা ১০৮টি প্রদীপের সলতে তৈরির মতো কাজে নারী নেই—এটি অসম্ভব। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মফস্সলে বা গ্রামে শিশুদের কাছে এমন রূপেই আসত শারদীয় দুর্গোৎসব। হেঁটে হেঁটে প্রতিমা দেখা যেত পাড়ার পাড়ায়। আজও লালপেড়ে ঘিয়ে শাড়ির কলাবউ বিস্ময় হয়ে আছে শিশুচোখে। গ্রামে মণ্ডপের দূরত্ব হতো ফসলের মাঠের হিসাবে।
নগরের মণ্ডপ দূরে দূরে বলে দুই বেলা যাওয়ার সুযোগ নেই। সব পর্বের আয়োজনটা তাই পাওয়া হয় না। প্রতিযোগিতার ফলে উৎসবের কৌলীন্য বেশি নগরে। কিন্তু স্থির চিত্তে উৎসব উদ্যাপনের সুযোগটা থাকে অজপাড়াগাঁয়ে ধানখেতের পাশে শ্রীহীন কোনো মণ্ডপে। সেখানে রঙিন কাগজ কেটে সাজানো হয় টিনের বেড়া। ঠাকুর মশাইয়ের মন্ত্রপাঠের সময় চোখ ছলছল করে গৃহস্থবাড়ির মানুষদের অথবা পথচলতি অখ্যাত বাউল মানুষটিরও।
রাজধানীতে সবচেয়ে জাঁকালো আয়োজনের অন্যতম বনানীর পূজামণ্ডপ। সেখানে প্রবেশ রীতিমতো লঙ্কাকাণ্ড। পূজার নিয়ম–আচার পালন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে। সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসবে সেখানকার ভিড়ের কথা বলতে গেলে জগন্নাথ হলের মণ্ডপের নাম বাদ দেওয়া ঠিক হবে না।
সম্প্রতি রমনা কালীমন্দিরের চাতাল বড় হয়েছে। ওই মণ্ডপের প্রবেশমুখে দেখা হয় পুকুরের পাশের ঝোপে আকন্দ ফুলের সঙ্গে। ভিড় থাকলেও মন প্রসন্ন হয়। তবে রাজধানীর নগরকেন্দ্রিক সব মন্দিরেই উচ্চ শব্দ ও অতিরিক্ত বিজলি বাতির আলো আর ভিআইপি-সাধারণের পার্থক্যে মনের উৎসবটা দেবীর কাছে ঠিক পৌঁছাতে পারে না সহজে। দর্শনের আনন্দ নিয়েই ফিরতে হয় মণ্ডপ থেকে।
কিছুটা ব্যতিক্রম পুরান ঢাকার উৎসবে। সেখানে একটু পরপর প্রতিমা তৈরি হয়। বাইরের শ্রীবৃদ্ধির চেয়ে এখানে ভক্তির ভাবটা বেশি; কিন্তু তা শুধু স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য। আমরা সেই আগন্তুকই রয়ে যাই। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না।
একই উৎসব অথচ মফস্সলের মণ্ডপে কত সহজে একজন বুঝতে পারে আরেকজনের কথা। সেই সুযোগে প্রতিমা দেখতে আসা অন্য ধর্মের শিশু ঠিক আবদার করে বসতে পারে চেনা কাকিমার কাছে নারকেলের নাড়ুর। লক্ষ্মীপূজায় সন্তানসম কন্যাটির আবদার মনে রেখে সেই নারী আরও দুটি নারকেল বেশি ধরেন হিসাবে। অষ্টমীর খিচুড়ি পাতে তুলে দিতে দিতে আশ্বাস দেন, নাড়ু পাবে কদিন পরেই।
আসলে নগরের শারদীয় দুর্গোৎসব মানুষের বাড়ি আর মণ্ডপকে যুক্ত করতে পারে না,
যেমনটা গ্রাম, মফস্সলে হয়। তাই নগরের মণ্ডপে থাকা প্রতিমাদের প্রতি ভালোবাসার দৈর্ঘ্য–প্রস্থটাও হয় কম।
তবে আয়োজন যেমনই হোক, মহাসমারোহের শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষটা মন খারাপের। বিসর্জনের জন্য মফস্সলে দেবীকে নেওয়া হতো ঠেলাগাড়িতে তুলে। ঠাকুর দালানের সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখা যেত তাঁর চলে যাওয়া। উঁচু স্থানে উঠে দেবী যেন আরও অনেক বড় হয়ে যেতেন আমাদের চোখে। দুর্গার মাথার পেছনে থাকা কৈলাসের মেঘের আদলের আলপনা ছোট হতে শুরু করত দূরে যেতে যেতে। দৃষ্টিসীমা থেকে মিলিয়ে গেলেই আমাদের মনে পড়ত সেই ‘একমেটে’ আপন মুখটির কথা। অনুভব করতাম, দুর্গা আর তাঁর সন্তানদের আমরা ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম সেই বাঁশ ও খড়ের আয়োজনের সময় থেকে।
লেখক: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক