ইসলামে হজ ও ওমরাহর বিধান

হজ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। হজ সম্পর্কে কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা আল ইমরান; আয়াত: ৯৭)।

হজের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা ও সফর বা ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কর্ম সম্পাদন করা। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো আশহুরে হুরুম বা হারাম মাসসমূহ তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ; বিশেষত ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। হজের নির্ধারিত স্থান হলো মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ইত্যাদি এবং মদিনা শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা। হজের বিশেষ আমল বা কর্মকাল হলো ইহরাম, তাওয়াফ ও সাঈ, অকুফে আরাফাহ, অকুফে মুজদালিফা, অকুফে মিনা, দম ও কোরবানি, হলক ও কছর এবং জিয়ারতে মদিনা-রওজাতুল রাসুল ইত্যাদি।

নবীজি (সা.) বলেছেন, প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা হজ পালন করবেন, আল্লাহ তাআলা তাঁদের হজ কবুল করবেন এবং তাঁদের জন্য অফুরন্ত রহমত ও বরকত অবধারিত। জীবনে একবার হজ করা ফরজ। সুযোগ থাকলে বারবার বা প্রতিবছর হজ করাতে বাধা নেই। যে কারও অর্থ দ্বারা হজ সম্পাদন করা যাবে। হাদিয়া বা অনুদানের টাকা দিয়েও হজ করলে তা আদায় হবে। চাকরি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল হিসেবে কর্তব্য কাজের সুবাদে হজ করলেও হজ আদায় হবে। এটি বদলি হজ না হলে নিজের ফরজ হজ আদায় হবে; ফরজ হজ পূর্বে আদায় করে থাকলে এটি নফল হবে। নফল হজ অন্য কারও বদলি হজের নিয়তে আদায় করলে তা-ও হবে।

রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘হজ মানুষকে নিষ্পাপে পরিণত করে, যেভাবে লোহার ওপর থেকে মরিচা দূর করা হয়।’ (তিরমিজি)। রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ পালন করে, সে পূর্বেকার পাপ থেকে এরূপ নিষ্পাপ হয়ে যায়, যেরূপ সে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন নিষ্পাপ ছিল।’ (বুখারি ও মুসলিম)। হজ প্রতিপালনে নিজে শারীরিকভাবে অক্ষম হলে অন্য কাউকে দিয়ে বদলি হজ করানো যায়। বদলি হজে যিনি হজ সম্পাদন করেন, যিনি অর্থায়ন করেন এবং যাঁর জন্য হজ করা হয়—সবাই পূর্ণ হজের সওয়াব লাভ করেন। যাঁরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ আদায় করতে পারেননি, তাঁদের কর্তব্য হলো বদলি হজ করানোর জন্য অসিয়ত করে যাওয়া। অসিয়তকৃত বদলি হজ অসিয়তকারীর সম্পদ বণ্টনের পূর্বে প্রতিপালন করা বা সম্পাদন করানো ওয়ারিশদের জন্য ওয়াজিব।

মৃত বা জীবিত যে কারও বদলি হজ করানো যায়। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব অথবা পরিচিত-অপরিচিত যে কেউ যে কারও বদলি হজ করতে বা করাতে পারেন। বদলি হজ সম্পাদনের জন্য আগে নিজের হজ আদায় করা শর্ত নয়; বরং নতুনদের দ্বারা বদলি হজ করালে তাঁর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, আবেগ ও অনুরাগ বেশি থাকে। তবে যাঁর ওপর হজ ফরজ অথচ নিজে আদায় করেননি, তিনি বদলি হজ করতে পারবেন না। বদলি হজ আত্মীয়-অনাত্মীয়, নারী-পুরুষ যে কেউ করতে পারেন। তবে বিজ্ঞ পরহেজগার লোক হলে উত্তম।

ওমরাহর আভিধানিক অর্থ হলো ধর্মকর্ম, ইবাদত, সুখকর, সেবা, স্থিতিশীল, জীবন, মহাপ্রাচীন, স্থাপত্য-স্থাপনা, প্রাপ্তি, অভ্যর্থনা, জিয়ারত বা সফর ও ইচ্ছা। যিনি ওমরাহ করেন, তাঁকে ‘মুতামির’ বলা হয়। ওমরাহর নির্দিষ্ট কাজকর্ম হলো ইহরাম, তাওয়াফ ও সাঈ, হলক, কছর ইত্যাদি। ওমরাহর নির্ধারিত স্থান হলো কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া ইত্যাদি। আফাকি তথা দূরবর্তী ওমরাহ সম্পাদনকারীর জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা সুন্নত।

ওমরাহ সম্পাদনের বিশেষ কোনো সময় সুনির্দিষ্ট নেই; তবে হজের নির্ধারিত বিশেষ সময়ে (৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন) ওমরাহ পালন করা বিধেয় নয়; এই পাঁচ দিন ছাড়া বছরের যেকোনো দিন যেকোনো সময় ওমরাহ প্রতিপালন করা যায়। হজের সফরেও ওমরাহ করা যায়। একই সফরে একাধিক ওমরাহ করতে বাধা নেই। হজ যেমন জীবনে একবার ফরজ; তেমনি ওমরাহ জীবনে অন্তত একবার সুন্নত। রমজানে ওমরাহ পালন করা হজের সমান সওয়াব; শাওয়াল মাসও ওমরাহ করার জন্য উত্তম সময়। তবে হজ ফরজ থাকা অবস্থায় তা আদায়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হজ সম্পন্ন না করে বারবার ওমরাহ করা অযৌক্তিক। কারণ, শত ওমরাহ একটি হজের সমকক্ষ হবে না। অনুরূপভাবে ওমরাহ আদায় করলে হজ ফরজ হয়ে যায় এমনটিও সঠিক নয়।

ওমরাহর জন্যও হজের মতোই মিকাত থেকে ইহরাম করতে হয়। বাংলাদেশ থেকে আমাদের মিকাত হলো ইয়ালামলাম পাহাড়, যা জেদ্দার পূর্বে অবস্থিত। মদিনা থেকে মিকাত হলো জুলহুলায়ফা নামক স্থান। মক্কা থেকে ওমরাহ করতে চাইলে তার মিকাত হলো তানয়িম বা আয়িশা মসজিদ অথবা জিরানা নামক জায়গা। (মক্কা থেকে হজের ইহরামের জন্য মিকাত প্রযোজ্য নয়)। ওমরাহকে ‘ওমরাহ হজ’ বা ছোট হজও বলা হয়। ওমরাহ নিজের জন্য যেমন করা যায়, তেমনি অন্যদের জন্যও করা যায়। জীবিত বা মৃত, ছোট বা বড়, আত্মীয় বা অনাত্মীয় যে কারও জন্য ওমরাহ আদায় করা যায়। ওমরাহ যেহেতু ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাই এর বদলি আদায় করা জরুরি নয়। তবে কোনো সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি অসিয়ত করে যান, তা আদায় করা ওয়াজিব হবে। এ ছাড়া কেউ কারও দ্বারা ওমরাহ করালে উভয়ে সমান সওয়াব পাবেন, কেউ কারও জন্য ওমরাহ সম্পাদন করলেও উভয়েই পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবেন।

ওমরাহ পালন করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল। এটি পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য প্রযোজ্য। ওমরাহ করলে হজ ফরজ হয়ে যায় এরূপ কোনো বিধান নেই। ওমরাহ সম্পর্কে কোরআন করিমে রয়েছে, ‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির একটি; তাই যারা হজ করবে বা ওমরাহ করবে, তারা এ দুটি প্রদক্ষিণ (সাঈ) করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৮)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।