আখিরাত বিশ্বাসের স্বরূপ
ইসলামি বিশ্বাসের মৌলিক বিষয় তিনটি। যথা: তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ, রিসালাত তথা নবী–রাসুলগণ ও আখিরাত অর্থাৎ পরকাল। পরকাল হলো মৃত্যুর পর পুনরায় অনন্ত জীবন লাভ করা। এই জীবনের সব কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার ও যথাযথ ভালো বা মন্দ ফলপ্রাপ্তি এবং পরিণাম হিসেবে জান্নাত ও জাহান্নাম ভোগ করা। বিশ্বাসীদের পঞ্চ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তারা আখিরাত বা পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৪)।
মানবজীবন চারটি জগতে পরিব্যাপ্ত। আলমে আরওয়াহ, আলমে দুনিয়া, আলমে বারজাখ ও আলমে আখিরাত। আলমে আরওয়াহ বা রুহের জগতে শুধু রুহ ছিল, সঙ্গে ছিল নফস। আলমে দুনিয়া বা দুনিয়ার জগতে রুহ ও নফসের সঙ্গে দেহ বা শরীর যোগ হয়েছে। মৃত্যুর মাধ্যমে রুহ ও নফস দেহ ছেড়ে আলমে বারজাখে পাড়ি দেয়। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘যখন কারও মৃত্যু হয়, তখন তার কিয়ামত সংঘটিত হয়।’ আলমে বারজাখ বা বারজাখ জগতে রুহ ও নফস ইল্লিন বা ছিজ্জিনে অবস্থান করবে এবং দেহ হয়তো বিলীন হয়ে যাবে, নয়তো সুরক্ষিত থাকবে। দ্বিতীয় কিয়ামত তথা শিঙায় প্রথম ফুৎকারে বড় কিয়ামত তথা সমগ্র সৃষ্টিকুলের প্রলয় বা ধ্বংস সংঘটিত হবে। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ জগতে যা কিছু আছে সবই লয়প্রাপ্ত হবে, শুধু আপনার রবের অস্তিত্বই টিকে থাকবে।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ২৬-২৭)। মৃত্যু বা প্রথম কিয়ামতের পর থেকে এবং দ্বিতীয় কিয়ামত বা শিঙায় প্রথম ফুৎকারের পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত আলমে বারজাখ বা বারজাখ জীবন। তৃতীয় কিয়ামত অর্থাৎ শিঙায় দ্বিতীয় ফুৎকারের পর হাশর ও নশর তথা পুনরুত্থান ও মহামিলন বা মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হবে। এটিই চূড়ান্ত কিয়ামত। এদিনই বিচারের দিন এবং আখিরাত বা পরকালের অনন্ত জীবনের সূচনা এদিন থেকেই হবে, যে জীবনের আর কোনো শেষ নেই, নেই কোনো সীমা বা পরিসীমা। এ জগতের কোনো পরিসমাপ্তি নেই।
ইমানের প্রাথমিক সপ্ত বিষয়ের অন্যতম দুটি বিষয় তথা পঞ্চম ও সপ্তম বিষয় দুটি হলো আখিরাত–সম্পর্কিত। যেমন ইমানে মুফাসসালে বিবৃত হয়েছে, ‘আমি ইমান আনলাম আল্লাহ তাআলার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসুলগণের প্রতি, আখিরাত বা পরকাল তথা শেষ বিচারের দিনের প্রতি, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ভালো–মন্দ তাকদির বা ভাগ্যের প্রতি, মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি।’ (ইমানে মুফাসসাল)।
আখিরাত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে। যেমন: ‘আর অবশ্যই আপনার জন্য প্রথম জগৎ দুনিয়া অপেক্ষা আখিরাতই উত্তম বা শ্রেয়। অচিরেই আপনার রব আপনাকে দান করবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।’ (সুরা-৯৩, ওয়াদ-দুহা, আয়াত: ৪-৫)।
আল্লাহ তাআলা আদি পিতা-মাতা বাবা হজরত আদম (আ.) ও মা হজরত হাওয়া (আ.)–কে সৃষ্টি করে জান্নাতেই রেখেছিলেন। পরে কুদরতের হেকমতে বা কৌশলগত কারণে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। আর বলে দিয়েছেন, তোমরা আমার হিদায়াত ও পথনির্দেশ অনুসরণ করলে আবার এখানেই ফিরে আসবে। আল্লাহ তাআলা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কেও মিরাজ রজনীতে জান্নাত দেখিয়ে এনেছেন, যাতে তিনি উম্মতদের এ বিষয়ে নিশ্চিতরূপে জানাতে পারেন। জান্নাত বা পরকালের বাড়ির আটটি নাম। যথা জান্নাতুল ফিরদাউস, জান্নাতুল মাওয়া, জান্নাতু আদন, দারুন নাঈম, দারুস সালাম, দারুল কারার, দারুল মাকাম বা দারুল মুকাম ও দারুল খুলদ।
পরকাল অনন্ত, সেখানে মৃত্যু নেই। ‘দারুল আখিরাত’ পরকাল সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। যেমন: ‘মুত্তাকিদের জন্য পরকালীন নিবাসই উত্তম।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৬৯)। ‘(হে রাসুল সা.) আপনি বলুন! হে আমার জাতি, তোমরা তোমাদের অবস্থান থেকে সামর্থ্যমতো সৎকর্ম করো, আমিও করছি; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে পরিণতির শুভ নিবাস কাদের জন্য।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৩৫)। ‘আল্লাহ তোমাদের আহ্বান করছেন শান্তিনিবাস পরকালের প্রতি।’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ২৫)। ‘তোমাদের প্রতি শান্তি! যেহেতু তোমরা ধৈর্য ধারণ করেছ, পরিণতি জান্নাতের বাড়ি কত-না উত্তম।’ (সুরা-১৩ রাআদ, আয়াত: ২৪)। ‘যারা সৎকর্ম করবে, তারা দুনিয়াতেও কল্যাণ লাভ করবে, পরকালের নিবাস অতি উত্তম; মুত্তাকিদের নিবাস কত-না উত্তম।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ৩০)। ‘আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তা দিয়ে পরকালের নিবাসের সন্ধান করো।’ (সুরা-২৮ কাছাছ, আয়াত: ৭৭)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com