'মুক্তিযুদ্ধ' পবিত্র বিষয়, এ নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জঘন্য অপরাধ
ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতা-কর্মীদের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্তত ২৪ জন আহত হন। তাঁদের মধ্যে চারজনকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়। নুরুল হক ও তাঁর সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাকে বর্বর ও পৈশাচিক বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ সংগঠনটির কর্মী পরিচয়ে এর আগেও নুরুলসহ একাধিক ছাত্রনেতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও গবেষকেরা। তাঁরা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে পবিত্র বিষয়। এ নাম নিয়ে সংগঠন বানিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা জঘন্য কাজ।
মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেই। কারা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ করছে, কারা কী করছে তা জানি না। তবে আমি সামগ্রিকভাবে বলব, আমি ৪৬ বছর শিক্ষকতা করেছি। আমরা শিক্ষাঙ্গনে কখনো কোনো এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমর্থন করিনি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় হলো যুক্তিতর্কের জায়গা। আমরা ছাত্র অবস্থায় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। কিন্তু তখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সমর্থন দিইনি। এনএসএফ যখন করেছে, তখন তা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। কারা এসব সন্ত্রাসী কাজ ঘটাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেছে বলে জানি না। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কারা করেছে তা জানি না। আর এমন নাম দিয়ে কেউ এ ধরনের কাজ করবে তা সমর্থনযোগ্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আমরা কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখতে চাই না। যে কোনো সংগঠন এটা করুক, তা মেনে নেওয়া যায় না। কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের নাম দেয় আমাদের কী করার আছে। নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁকে নির্বাচিত করেছে। একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর তাঁরা কীভাবে আক্রমণ করেন? এটাও বাঞ্ছনীয় নয়। এই আমলে আমরা এটা আশা করি না।
মিজানুর রহমান, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করে সংগঠন বানিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড, এটা জঘন্যতম অপরাধ। পবিত্র শব্দ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কে কেউ কলুষিত করবে, এটা কখনই হতে দেওয়া যায় না। যারাই করুক, যে দর্শনই তাদের থাকুক ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দকে কালিমালিপ্ত করতে দেওয়া উচিত নয়। যারা এসব কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে সত্ত্বর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রাষ্ট্রকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এক কথিত মঞ্চের পেছনে আছেন বলে জানি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কীভাবে এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়ায় তা আমার কাছে বোধগম্য হয় না। একজন শিক্ষক হিসেবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কেউ জড়াবে, আমাদের শিক্ষক সমাজকে হেয় করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। কদিন আগেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এসে কীভাবে আমাদের ভাবমূর্তি ফেরানো যাবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে গেলেন। এসব শোনার পরও কেউ এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে বেড়াবে, এটা খুব দুঃখজনক। এটার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তো বটেই। এর পাশাপাশি আজ যা হলো সেই ঘটনায় দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। শক্তি প্রয়োগ করাই একটা অপরাধ। যারা আজ সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছে শুধু তাদেরই নয়, এর পেছনে যারা আছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সাদেকা হালিম, অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি অত্যন্ত পবিত্র। যেখানে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, এত মা-বোনের ইজ্জত চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি যদি কোনো কিছুর নামকরণ করি তবে সেই পবিত্রতা রক্ষা করেই এ নামটা দিতে হবে। আমি আমার ব্যক্তিস্বার্থে যেন এই পবিত্র বিষয়টিতে যেন ব্যবহার না করি। কোনো সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যবহার না করি। যারা মুক্তিযোদ্ধা তাদের সঙ্গে আমরা আলাপ আলোচনা করে নিতে পারি আমরা কী করছি, কেন করছি সে বিষয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এত প্রাণ গেছে। যারা বেঁচে আছে তাদের অনেকেই সার্টিফিকেট পর্যন্ত নেননি। কারণ তাদের অনেকেই মনে করেন, তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। তারা দেশ স্বাধীন করেছেন। তারা ব্যক্তিস্বার্থে এটা ব্যবহার করেননি। আমরাও চাই না কেউ এটার অপব্যবহার করুন। আমার পরিবারে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আছেন। কেউ এটা নিয়ে খারাপ কিছু করলে কষ্ট হয়। আজ হামলার ঘটনার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গেছেন। এটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক একটি দিক।