আলোচনায় খালেদা জিয়া, ড. কামাল, ফখরুল বা জিয়া পরিবারের কেউ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার করেনি। নির্বাচনে যেতে দলটির কোনো শর্তে সরকার ‘গা’ করছে না। উল্টো নিত্য-নতুন পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপির দাবির সংখ্যা কেবল বাড়িয়েই চলছে ক্ষমতাসীনরা। তবে সরকারের অনড় অবস্থান, বৈরী পরিস্থিতি থাকলেও টানা ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি এবার ভোটে যেতে প্রস্তুতি শুরু করেছে। নানা প্রস্তুতির মধ্যে জাতীয় ঐক্য বা বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার ঘোষণা সেই প্রস্তুতিরই একটি অংশ। দলটি ছাড় দিয়ে হলেও বৃহত্তর ঐক্য গড়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বিএনপি এবার নির্বাচন হাতছাড়া করতে চায় না। নির্বাচনের ব্যাপারে জেলে থাকা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। নির্বাচন ঘিরেই এখন দলের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বৃহত্তর জোট নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে।
ঐক্য প্রক্রিয়ায় সঙ্গে থাকা বিএনপির নেতারা বলছেন, আপাতত নির্বাচনকালীন সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ‘যুগপৎ’ আন্দোলনে আলাদা নেতৃত্ব নিয়েই থাকছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপি ও তার শরিক দলগুলোর মধ্যে এই প্রশ্ন উঠেছে, এখন বিএনপি আলাদাভাবে নিজ নেতৃত্বকে ঐক্য প্রক্রিয়ায় রাখছে কিন্তু ভোটের বা নির্বাচনকালীন জোট হলে সেখানে কে নেতৃত্ব দেবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে এখন যুক্তফ্রন্ট, গণফোরাম ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা।
জাতীয় ঐক্যের দলগুলো যে যার অবস্থান থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করবে। কিন্তু নির্বাচনে গেলে কার নেতৃত্বে তারা অংশ নেবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে। নির্বাচনের আগে তাঁর মুক্ত হওয়া নিয়ে বিএনপিই সংশয়ে। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও দেশে আসার অবস্থায় নেই। যুক্তফ্রন্ট থেকে বি চৌধুরী কোনো পদ নেবেন না বলে জানিয়েছেন।
বিএনপি, গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টের নেতারা বলছেন, এখন আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ঐক্য হচ্ছে। আগামী দিনে এটা নির্বাচনী জোটেও রূপ নিতে পারে। তখন একজন নেতাকে সামনে রাখতে হবে। যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম মিলে যে জোট হয়েছে, তাতে ড. কামাল হোসেনকে সামনে রাখার ব্যাপারে জোট অনেকটাই একমত। অন্যদিকে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানকে রাখা সম্ভব না হলে অন্তত জিয়া পরিবারের কাউকে অথবা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সামনে আনার পক্ষে। জিয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে এগিয়ে রাখার পক্ষে। কেউ কেউ ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথির কথাও বলছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির জন্য তাঁরা এখন আন্দোলন করবেন। দাবি আদায়টাই এখন মুখ্য। তবে নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানান। নির্বাচনী জোট ও নেতৃত্ব নিয়ে তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করার জন্য সবাই কাজ করবেন। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত হবে এই জোট একসঙ্গে নির্বাচন করবে কি না। কার নেতৃত্বে নির্বাচন হবে, তা তখনই ঠিক করা হবে।
বিএনপির সূত্রটি জানায়, নির্বাচনী জোটে কে নেতৃত্ব দেবেন এবং সরকার গঠন করলে তার প্রধান কারা হবেন, এসব বিষয় খালেদা জিয়াই নির্ধারণ করবেন। নেতৃত্বে থাকতে পারেন জাতীয় ঐক্য থেকে সমাজে গ্রহণযোগ্য কেউ, দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিসম্পন্ন এবং খালেদার পরিবারের কেউ।
দর-কষাকষি, শাসনতন্ত্র, আন্দোলনের ইস্যুসহ নানান বিষয় নিয়ে কয়েক মাস ধরেই যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। যে দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল, তার নেতারা সম্প্রতি একসঙ্গে একটি সভায় যোগ দেন। ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে নাগরিক ঐক্য আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা বলেন।
যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যের নেতারা কর্মসূচি পালন করবেন। তবে নির্বাচনী জোট হলে সেখানে একটি নামও দরকার হবে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে দুটি নাম প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে—‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ ও ‘জাতীয় ঐক্য পরিষদ’। তবে সূত্র জানায়, ‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ নামটাকেই নেতাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।
গতকাল রোববার রাতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিকেরা বিএনপিকে বৃহত্তর ঐক্য বা জোটের আকার বাড়ানোর ব্যাপারে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছে। তারা বলেছে, বিএনপির এই প্রচেষ্টার সঙ্গে শরিকেরা একমত। ২০-দলীয় জোটের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি ২০-দলীয় জোটের বাইরেও আলাদাভাবে বৃহত্তর ঐক্য করতে চাইছে। বিশেষ করে ২০ দলে জামায়াতে ইসলামী থাকায় বিএনপিকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা জানতে চেয়েছেন, বৃহত্তর জোটের নেতৃত্ব কে থাকছেন? তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, এটা পরে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
বিএনপির সঙ্গে জোটে যেতে যুক্তফ্রন্ট বারবারই ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলে আসছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যুক্তফ্রন্টের নেতারা বলছেন, বর্তমান রাজনীতিতে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। এক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এমন কাউকে ক্ষমতায় দেখতে চান না, যারা একই পথে পুনরায় হাঁটবে। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনাই তাঁদের লক্ষ্য বলে একাধিকবার বলেছেন। বিএনপিও এই দাবির সঙ্গে অনেকটাই একমত পোষণ করে এগোচ্ছে বলে জানা যায়। দলের উচ্চপর্যায় থেকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক নির্দেশনা আছে।
নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, একটা ব্যাপারে এখন বিএনপি ও তাঁরা একমত, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। বিএনপিও ছাড় দেওয়ার কথা বলছে। ফলে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব নিয়ে সমস্যা হবে না। সবাই মিলে বলছে, জ্যেষ্ঠ ও গ্রহণযোগ্য কেউ নেতৃত্ব দিতে পারবেন। সময় হলেই এ ব্যাপারে আলোচনা করে সবকিছু ঠিক হবে।