ইসি গঠনে প্রস্তাবিত নাম
সাবেক আমলাদের আধিক্য
অনুসন্ধান কমিটির কাছে জমা হওয়া ৩২২ জনের নাম প্রকাশ। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সাবেক আমলা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চারজন উপদেষ্টার নাম এসেছে। তাঁরা সবাই নারী।
দুজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নামও এসেছে তালিকায়।
সাবেক দুই সেনাপ্রধান এবং সাবেক দুই আইজিপির নামও রয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে আসা ৩২২ জনের নাম প্রকাশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সাবেক আমলা। এ ছাড়া বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষক, আইনজীবী, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন তালিকায়।
অনুসন্ধান কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে গতকাল সোমবার রাত আটটার পর প্রস্তাবিত নামগুলো প্রকাশ করা হয়। তবে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কারা এসব ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশিত নামের মধ্যে কিছু নাম একাধিকবার এসেছে। কয়েকটি নামের ক্ষেত্রে বানান ও পদবির ভুল হতে পারে বলে স্বীকার করে নিয়েছে কমিটি। এসব সংশোধন করা হবে বলে কমিটি জানিয়েছে।
ইসির গঠনে যোগ্য ব্যক্তিদের জন্য আরও যেসব ব্যক্তির নাম জমা পড়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী ও ডা. সুফিয়া রহমান।
এর আগে গত রোববার বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে বৈঠকে অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান জানিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে জমা হওয়া সব নাম প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (শুক্রবার বিকেল পাঁচটা) নাম জমা দিতে পারেনি, তাদেরও নাম দিতে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। এ জন্য নাম জমা দেওয়ার সময়সীমা আরও ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে গতকাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত করা হয়েছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ কয়েকটি দল নাম দেয়নি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মোট ১৩৬ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। পেশাজীবী সংগঠন দিয়েছে ৪০ জনের নাম। নির্ধারিত ই-মেইলে এসেছে আরও ৯৯ জনের নাম, আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে নাম প্রস্তাব করেছেন ৩৪ জন। এ ছাড়া বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময়ও বেশ কিছু নামের প্রস্তাব পেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। সেগুলোই গতকাল একসঙ্গে প্রকাশ করা হয়।
অনুসন্ধান কমিটির প্রকাশ করা তালিকায় ৫৪ জন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশিদ, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি মো. রহমত উল্লাহ, সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রমুখ।
প্রকাশিত নামগুলোর মধ্যে সরকারের সাবেক আমলাদের আধিক্য বেশি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা ও মোহাম্মদ শফিউল আলম, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব মোহাম্মদ সাদিক, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব মোহাম্মদ আবদুল করিম, আবুল কালাম আজাদ ও নজিবুর রহমান, সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল, কাজী রওশন আক্তার, উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত, মহিবুল হক, মোস্তফা কামাল উদ্দিন, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ। তালিকায় ৯৫ জন সাবেক আমলার নাম রয়েছে।
আইন অনুযায়ী, ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করতে হবে। এ কমিটি গঠন করা হয় ৫ ফেব্রুয়ারি। সেই হিসেবে তাদের হাতে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় আছে। অনুসন্ধান কমিটি ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।
অনুসন্ধান কমিটির প্রকাশ করা তালিকায় ৫৪ জন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশিদ, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি মো. রহমত উল্লাহ, সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রমুখ।
সাবেক বিচারপতি ও বিচারক
তালিকায় সাবেক একাধিক প্রধান বিচারপতির নাম যেমন রয়েছে, তেমনি অধস্তন আদালতের সাবেক বিচারকেরাও রয়েছেন। সম্প্রতি অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নামও রয়েছে তালিকায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিয়া, এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকীর নাম রয়েছে। এ ছাড়া সাবেক বিচারপতি মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, সাবেক দায়রা জজ খান. মো. আবদুল মান্নানের নাম রয়েছে এ তালিকায়। সাবেক বিচারপতি, বিচারক ও আইনজীবীসহ বিচারাঙ্গনের ৬৭ জনের নাম রয়েছে তালিকায়।
সশস্ত্র বাহিনীর যাঁরা
সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া ও হারুন–অর–রশিদ। এ ছাড়া রয়েছেন মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান ও জামিল ডি আহসান। বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল (অব.) ফখরুল আজম। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধে৵ রয়েছেন সালেহউজ্জামান, সাইদুর রহমান খান, সেলিম মাহমুদ চৌধুরী, মো. রেফায়েত উল্লাহ প্রমুখ। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের নামও রয়েছে তালিকায়। তিনি নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক ২৮ জন কর্মকর্তার নাম রয়েছে তালিকায়।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারাও রয়েছেন
অন্তত ১০ জন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে প্রকাশিত তালিকায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং এ কে এম শহীদুল হক। এ ছাড়া সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মোখলেছুর রহমান, মাহাবুব হোসেন প্রমুখ।
অনুসন্ধান কমিটির কাছে জমা পড়া সব নাম প্রকাশের জন্য আগেই দাবি উঠেছিল। গত শনিবার ও রোববার অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা এই দাবি করেছিলেন।
সাবেক চার উপদেষ্টার নাম তালিকায়
ইসির গঠনে যোগ্য ব্যক্তিদের জন্য আরও যেসব ব্যক্তির নাম জমা পড়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী, গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী ও ডা. সুফিয়া রহমান। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিশেষচ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, আইনজীবী শাহদীন মালিকসহ নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের বেশ কয়েকজনের নাম এসেছে। তালিকায় বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও আতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর ও বিনায়ক সেন, প্রকৌশলী এম শামীম জেড বসুনিয়া, আইনজীবী এম কে রহমান, ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ, সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মোহাম্মদ জসীম উদ্দিনের নামও আছে ।
এবারের অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন, চিত্রনায়ক এবং নিরাপদ সড়ক চাই–এর প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনের নামও প্রস্তাবিত তালিকায় রয়েছে।
এদিকে অনুসন্ধান কমিটি আজ মঙ্গলবার বিকেলে আরও আটজন সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে বৈঠক করবে। এরপর কমিটি তাদের পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করবে।
স্বাধীনতার পর এবারই আইন অনুযায়ী প্রথম ইসি গঠিত হচ্ছে। গত ২৭ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। এ নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ের কাজ করছে।
অনুসন্ধান কমিটির বাছাই করা ১০টি নাম প্রকাশের জন্য ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে চিঠি দিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। এ ছাড়া অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকেও একই দাবি উঠেছে। বিশিষ্ট নাগরিকেরা অনুসন্ধান কমিটিকে পরামর্শ দিয়েছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং ইসিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন, এমন ব্যক্তিদের বাছাই করতে হবে। যাঁরা হবেন সৎ ও সাহসী এবং রাজনৈতিক দলের চাপে মাথা নত করবেন না। তাঁরা আরও বলেছেন, মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবেন এবং একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারবেন, এ রকম সাহসী লোক দরকার। আগামী নির্বাচন যদি আগের মতো হয়, তবে দেশ একটা বিপদের মধ্যে পড়বে।