সাংসদ পদও কি হারাবেন মুরাদ হাসান?
অশালীন ও নারীর প্রতি অবমাননাকর কথা বলে মন্ত্রিত্ব হারানোর পর দলীয় পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে সুপারিশ করছে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগ। এই প্রেক্ষাপটে দলের প্রাথমিক সদস্যপদও হারালে মুরাদ হাসান সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে জামালপুর-৪ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন মুরাদ হাসান। সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে দুভাবে প্রার্থী হতে পারেন। কোনো দলের প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। কোনো ব্যক্তি একটি দল থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর ওই দল থেকে পদত্যাগ করলে সংবিধান অনুযায়ী তাঁর সংসদ সদস্য পদ থাকবে না।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। কিন্তু দল যদি কাউকে বহিষ্কার করে সে ক্ষেত্রে কী হবে, সংবিধানে তার উল্লেখ নেই।
তবে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন সংসদ-সদস্যের আসন শূন্য হইবে কিনা, সে সম্পর্কে কোন বিতর্ক দেখা দিলে শুনানী ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের নিকট প্রেরিত হইবে এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হইবে।’
অবশ্য মুরাদ হাসান এখনো দল থেকে পদত্যাগ করেননি। দলের প্রাথমিক সদস্যপদও এখনো হারাননি। তিনি ছিলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক। জেলা আওয়ামী লীগের এক জরুরি সভায় আজ তাঁকে এই পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কাছে সুপারিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদ থাকবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মুরাদ হাসানকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভাগ্যই বরণ করতে হতে পারে।
এর আগে দশম সংসদে ২০১৪-২০১৫ সালে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বিতর্কিত মন্তব্য করে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন সাবেক সাংসদ আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করেছিল আওয়ামী লীগ। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, তাঁর সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, কারণ তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দল থেকে বহিষ্কারের পর লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের সুপারিশ করে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) চিঠি দেন স্পিকার। পরে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগ ও লতিফ সিদ্দিকীর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল।
ইসিকে দেওয়া ব্যাখ্যায় লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিল আওয়ামী লীগ। দলটির তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সই করা সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনে বলা হয়েছে, প্রার্থী মানে দল কর্তৃক মনোনীত বা স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ব্যক্তি। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নির্বাচনের আগে ও পরে নেই। দলের সকল পদ থেকে বহিষ্কার হওয়ায় বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের কেউ নন। যে কারণে তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকার আইনগত অধিকার হারিয়েছেন।’
অন্যদিকে লতিফ সিদ্দিকী ইসিকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ও দেউলিয়া ঘোষিত হলে, বিদেশি রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করলে, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হলে, প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে থাকলে এবং ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দল থেকে পদত্যাগ করলে বা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তাঁর সদস্যপদ শূন্য হতে পারে।
কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আনীত অভিযোগ এসবের কোনোটিতেই পড়ে না। যে কারণে নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে শুনানির এখতিয়ার নেই। লতিফ সিদ্দিকী তাঁর অবস্থানের পক্ষে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, কোনো সদস্য দল থেকে বহিষ্কৃত হলে তাঁর সদস্যপদ বহাল থাকবে এবং সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি ওই দলের সদস্য হিসেবে গণ্য হবেন।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে গিয়ে নিজেই সাংসদ পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর লতিফ সিদ্দিকীর আসনটি শূন্য হওয়ার বিষয়টি সংসদকে অবহিত করেন স্পিকার।সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ বা জেলা কমিটির দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সঙ্গে সংসদ সদস্য পদ থাকা না থাকার সম্পর্ক নেই। তবে দল থেকে যদি তাঁকে খারিজ করে দেওয়া হয়, তখন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ আসবে। তিনি যে দলের পরিচয়ে নির্বাচন করে নির্বাচিত হয়েছেন, সে দল যদি তাঁকে দল থেকে বের করে দেয়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদে তাঁর সদস্য পদ থাকার কথা নয়। এ রকম পরিস্থিতি হলে সেটা নির্বাচন কমিশনে যাবে। নির্বাচন কমিশন ৭০ অনুচ্ছেদের আওতায় সিদ্ধান্ত নেবে।
অবশ্য দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকার নজির আছে। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাংসদ আবু হেনাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিল বিএনপি। তখন আবু হেনার সংসদ সদস্য পদ বহাল রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তৎকালীন স্পিকার।