ড. কামাল হোসেনের ভাষায়, ‘আলোচনা ভালো হয়েছে’ এবং মির্জা ফখরুল ইসলামের ‘আলোচনায় সন্তুষ্ট নই’—মন্তব্য দুটির ভেতরে একটা পার্থক্যের সুর থাকলেও সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে এমন কথা কোনো পক্ষেরই কেউ বলেননি। বরং ক্ষমতাসীন দলের নেতা ওবায়দুল কাদেরের কথায় ইঙ্গিত মেলে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়নি। তিনি বলেছেন, আর আলোচনা হবে কি না, তা ৮ নভেম্বরের পর বলা যাবে। এসব বক্তব্যে ইঙ্গিত মেলে, উভয় পক্ষই সংলাপ অব্যাহত রাখার আশা জিইয়ে রাখতে আগ্রহী।
রাজনৈতিক বিভাজনের দুই প্রান্তে থাকা দুটি জোটের মধ্যে প্রায় সব বিষয়েই অবস্থান যখন বিপরীতমুখী, তখন সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠকে সমঝোতা বা সংকট নিরসনের আশা যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতেই পারেন। কিন্তু, সেই ক্ষোভ ও হতাশা আবেগতাড়িত, বাস্তবসম্মত নয়। ‘সব সময় কি সব হয় নাকি’—মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যেই তার স্বীকারোক্তি রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আবেগের তাড়না থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা, তাঁদের দলীয় প্রধান জেলে এবং সংলাপের আমন্ত্রণের পর একটি মামলায় তাঁর সাজা দ্বিগুণ হয়েছে; আরেকটি মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড, আচমকা দলের গঠনতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করতে নির্বাচন কমিশনের ওপর হাইকোর্টের আদেশ জারি এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় অব্যাহত থাকার ঘটনাগুলোতে সরকারের কঠোর মনোভাব বজায় থাকারই প্রতিফলন ঘটেছে। যদিও, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে শুভেচ্ছার নমুনা হিসেবে উদারতার প্রত্যাশাই স্বাভাবিক।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সংলাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে, তাঁরা সংবিধানের মধ্যেই কীভাবে সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব, তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। আদালতের রায়ে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, সেটি এখনো কাজে লাগানোর অবকাশ আছে, এ কথাটিও তাঁরা বলেছেন। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবকে ভিত্তি করে আলোচনার কথাও এসেছে। রাজনৈতিক সংকট সমাধানে রাজি হলে প্রয়োজনে সংবিধানসম্মত অন্য আরও বিকল্প তাঁরা দিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধানের বাইরে কিছু সম্ভব নয় বলা হলেও সংবিধানসম্মত বিকল্প নিয়ে আলোচনার কথা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়নি। সেদিক দিয়ে সংলাপকে ব্যর্থ বা এর ফলাফল শূন্য বলা অযৌক্তিক।
সভা-সমাবেশ করার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না বলে যে আশ্বাস প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, সেটিকে কাজে লাগাতে পারাও এখন ঐক্যফ্রন্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এর মধ্য দিয়ে তারা সাংগঠনিকভাবে নিজেদের গোছানোর এবং দ্বিতীয়ত, তাদের দাবির সপক্ষে জনসমর্থনের প্রকাশ ঘটানোরও সুযোগ পাচ্ছে। ফলে, তারা যদি এখন মাঠের কর্মসূচিতে মনোযোগী হয়, তাহলে তাতে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। অন্যদিকে, সভা-সমাবেশে বাধা পেলে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে। সরকারের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলার তালিকা চাওয়ার বিষয়টিকেও ঐক্যফ্রন্ট কাজে লাগাতে পারে।
সংলাপে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন বা তাঁর মুক্তির বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার আশা আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের কেউ করে থাকলে বলতেই হবে যে রাজনীতিতে তাঁর প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ এখনো বাকি আছে। ‘মামলার বিষয়গুলো আদালতের এখতিয়ার’ এই উত্তরই তো প্রত্যাশিত। তবে, আপিল প্রক্রিয়ায় সরকার যে ভূমিকা নিয়েছে, ভবিষ্যতে যদি তা থেকে বিরত থাকে, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁর জামিন পাওয়া একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। সংলাপে যদি মূল রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে অগ্রগতি হয়, তাহলে তার প্রভাবে ভিন্ন কিছু হওয়া একেবারে অসম্ভব এমনটি বলা যায় না।
তবে, সংলাপ ঘিরে সরকারের অনুসৃত কৌশল যে অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, সে কথাও অস্বীকারের উপায় নেই। প্রথমত, সংলাপের পরিসর বাড়াতে সরকারের অতি আগ্রহ এবং দ্বিতীয়ত, সংকটের কেন্দ্র থেকে জন–আলোচনাকে ভিন্নদিকে সরানোর চেষ্টায় তা স্পষ্ট। নিতান্তই ঠুনকো বিষয়গুলোতে নানা ধরনের মুখরোচক আলোচনায় সেই আলামতই মেলে। গণভবনের নৈশভোজের খাদ্যতালিকায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের পছন্দের খাবার অন্তর্ভুক্ত হওয়া কিংবা ফ্রন্টের নেতাদের ভোজনপর্ব বর্জনের ঘোষণা এবং সংলাপ চলাকালেই বিএনপি নেতাদের ফলের রস পান এবং বাদাম চিবোনোর ছবি প্রকাশের বিষয়গুলো কাকতালীয় মনে করা কঠিন। কারও কারও কাছে তাই আলোচনায় কে কী বলেছেন, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কে কী খেয়েছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি এবং সাবেক আওয়ামী লীগ হিসেবে একটা বিভাজন তুলে ধরার চেষ্টাও এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।
সংলাপের মূল বিষয়, একটা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার। সেই আলোচনায় সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন হবে কেন, তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। জাতীয় পার্টির তো এ ধরনের কোনো দাবি নেই। মনে হচ্ছে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার ব্যবস্থার চাইতে সংলাপকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোটাই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। সবার মতামতের ভিত্তিতে একটা জাতীয় সমঝোতা গড়ে তোলা যদি সরকারের লক্ষ্য হতো, তাহলে তো একটা সর্বদলীয় কনভেনশনই ছিল উত্তম ব্যবস্থা। বামপন্থীদের জোট কিংবা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার আলোচনার অনুরোধও যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এসেছে তা নয়। সরকার ড. কামালের অনুরোধে সাড়া দিয়েছে জানার পরই বিকল্পধারা তাঁকে অনুসরণ করে। আর, বামপন্থীদের কাছে তো সরকারই অনুরোধপত্র চেয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, সংলাপের জন্য সরকারের কাছে ২০টির মতো অনুরোধ এসেছে। ফলে, আশঙ্কা হয় যে সংলাপ না শেষ পর্যন্ত একটা লোকদেখানো নাটকে পরিণত হয়।
ঐক্যফ্রন্টের অগ্রাধিকার হচ্ছে সাত দফায়। কিন্তু, সরকারের তা নয়। তার প্রয়োজন এমন একটা নির্বাচন, যেটি যেন ২০১৪–এর পুনরাবৃত্তি না হয় এবং ক্ষমতাও যাতে হারাতে না হয়। সুতরাং, আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় যদি জন-আলোচনায় প্রাধান্য পায়, তাহলে সরকারেরই তাতে সুবিধা। সরকার সেখানে সদ্য গড়ে ওঠা জোটে ভিন্নমত উসকে দেওয়ার সুযোগ খুঁজবে, সেটাই স্বাভাবিক। সংলাপের আলোচনায় যেসব বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সরকারের শরিক দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যে সেই চেষ্টার প্রতিফলন দেখা যায়।
আমরা জানি, উদারপন্থী গণতন্ত্রী হিসেবে ড. কামালের রাজনৈতিক আদর্শগত অবস্থান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে একেবারেই স্বতন্ত্র। মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যও অনেকটা সেই পথেরই পথিক। ফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপির ডানপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তাদের সমঝোতা একেবারেই ইস্যুভিত্তিক ও সাময়িক। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক যে এই বৃহত্তর ঐক্যফ্রন্টেও অদৃশ্য অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। জামায়াতের বিষয়ে অতীতে নীরবতা অবলম্বনকারী বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার এই ইস্যুতে ঐক্যপ্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ানো সেই সাক্ষ্যই দেয়। সংলাপের পরিসর বিস্তৃত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বিষয়টি আবারও বড় হয়ে উঠতে পারে।
রাজনৈতিক অবস্থান ও আদর্শের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে দূরত্ব অনেক। গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের প্রশ্নে ন্যূনতম কর্মসূচিতে তাদের যে সমঝোতা এখনো পাকাপোক্ত রূপ নিয়েছে, এমনটি বলা যাবে না। সংলাপের প্রক্রিয়ায় তাদের এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর সম্ভাবনায় সরকার–সমর্থকদের অনেকেই কিছুটা উচ্ছ্বসিত। এ ধরনের কৌশল সফল হলে ক্ষমতাসীনেরা সাময়িকভাবে লাভবান হলেও রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হওয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে তার পরিণতি কারও জন্যই সুখকর হবে না। ১৯৯৬, ২০০৬ ও ২০১৩–এর সংলাপগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি কেউই প্রত্যাশা করে না। সংলাপে আরও সংলাপের পথ প্রশস্ত হওয়ার একটা অগ্রগতি হলেও সংলাপ যতক্ষণ অর্থবহ পরিণতি লাভ না করছে, ততক্ষণ কোনো আশ্বাসেই মানুষের আস্থা অর্জন সম্ভব হবে না। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আশ্বাসে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রলুব্ধ করা গেলেও নির্বাচনব্যবস্থায় মানুষ যে আস্থা হারিয়েছে, তা ফেরানো সম্ভব হবে না।