ঢাবি ছাত্রলীগের হল কমিটি
শীর্ষ চার নেতার ‘অঞ্চলপ্রীতি’
অপরাধী বা বিতর্কিতদের নেতৃত্ব না আনার ঘোষণা দেওয়া হলেও বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িতরাও হল ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ পেয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ১৮টি হলের নেতৃত্ব বাছাইয়ে সংগঠনের শীর্ষ নেতারা নিজ অঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের চার শীর্ষ নেতার গ্রামের বাড়ি যে অঞ্চলে, সেই অঞ্চল থেকেই বেশিসংখ্যক ছাত্র নেতৃত্বে এসেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত কয়েকজনও হল কমিটিতে শীর্ষ পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৩০ জানুয়ারি সমন্বিত সম্মেলনের পর গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক বছরের জন্য এই কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছে।
নেতৃত্বে আসতে না পারা হল পর্যায়ের একাধিক নেতার অভিযোগ, কমিটি গঠনে সাংগঠনিক দক্ষতা কিংবা আদর্শিক অঙ্গীকারের চেয়ে শীর্ষ পদপ্রত্যাশীদের জন্মস্থানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি ভারসাম্যহীন। নেতৃত্বে আসা অনেকের বিরুদ্ধেই নানা গুরুতর অভিযোগ ছিল, যা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
সমন্বয় করে সব অঞ্চল থেকেই নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটি সম্ভবও হয়েছে। কিছু কম, কিছু বেশি, এটি তো হয়ই।
শীর্ষ নেতাদের পদ ভাগাভাগি
সংগঠনের রীতি অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ৩৬টি পদ শীর্ষ চার নেতার মধ্যে ভাগাভাগি হয়। গত মঙ্গলবার রাতে সেই ‘ভাগ-বাঁটোয়ারায়’ বসেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। দীর্ঘ আলোচনার পর তাঁরা কমিটি ঘোষণা করেন। ৩৬টি পদের মধ্যে আল নাহিয়ান ও লেখক সাতটি করে এবং সনজিত ও সাদ্দাম ১১টি করে পদ ভাগে পান বলে কমিটি গঠনে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাহিয়ান খান যে সাতজনকে হল কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেছেন, তাঁদের মধ্যে চারজনের গ্রামের বাড়ি বরিশাল অঞ্চলে। নাহিয়ানের বাড়ি বরিশাল জেলায়। লেখক ভট্টাচার্য যে সাতজনকে হল কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করেছেন, তাঁদের মধ্যে চারজনের গ্রামের বাড়ি খুলনা অঞ্চলে। লেখকের বাড়ি যশোরে। এ ছাড়া তিনটি হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিনজনকে মনোনীত করেছেন লেখক।
সনজিত চন্দ্র দাসের বাড়ি ময়মনসিংহে। তাঁর মনোনীত ১১ জনের মধ্যে ৮ জনই ময়মনসিংহ অঞ্চলের। অন্য তিনজনের মধ্যে দুজনের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে। সাদ্দাম হোসেনের বাড়ি পঞ্চগড়ে। তাঁর মনোনীত ১১ জনের মধ্যে ৪ জনের বাড়ি উত্তরবঙ্গে। অন্যদের মধ্যে কুমিল্লা জেলা থেকে দুজনকে মনোনীত করেছেন সাদ্দাম।
নেতৃত্বে আসতে না পারা একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, চার শীর্ষ নেতা শুধু নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অঞ্চল বিবেচনায় নেতৃত্ব নির্ধারণ করেছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বয় করে সব অঞ্চল থেকেই নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। সেটি সম্ভবও হয়েছে। কিছু কম, কিছু বেশি, এটি তো হয়ই। যোগ্য হয়েও যাঁরা নেতৃত্বে আসতে পারেননি, তাঁদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটিতে সংযোজন করা হবে।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িতরাও আছেন
সনজিত–সাদ্দাম শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, হল কমিটিতে কোনো অপরাধী বা বিতর্কিত ব্যক্তির স্থান হবে না। তবে কমিটি ঘোষণার পর দেখা গেছে, নানা গুরুতর অভিযোগ থাকা কয়েকজনকে নেতৃত্বে আনা হয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিনকে মারধরের ঘটনায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় সংগঠন থেকে তদন্ত কমিটি হলেও পরে আর কিছুই হয়নি।
২০১৯ সালের ১৩ মে মধুর ক্যানটিনে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক হাসিবুল হোসেনের। ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটি তার প্রমাণও পায়। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয় তাঁকে। তিনি জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়েছেন।
২০১৭ সালের ১ জুন রাতে বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আবু ইউনুসকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ২১ জুন এক প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে নির্যাতন, মুঠোফোন ছিনতাই ও চাঁদা দাবির অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবু তিনি ওই হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া মারিয়াম জামানের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের অক্টোবরে টিএসসি এলাকায় দুই সাংবাদিককে মারধরে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের দাবি, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্যক্তিরাই নেতৃত্বে এসেছেন। যাঁদের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা হলুদ সাংবাদিকতার শিকার।