সরেজমিন ময়মনসিংহ, রাজনীতি—৩
শিববাড়ি থেকে কালীবাড়ি, আ.লীগে নতুন মেরুকরণ
একসময় দাপট ছিল সাবেক ধর্মমন্ত্রীর ছেলে মোহিত উরের। এখন মেয়র ইকরামুল ও তাঁর ভাইয়ের আধিপত্য।
ময়মনসিংহ শহরের প্রধান সড়ক, অলিগলিতে রাজনৈতিক সাইনবোর্ড, ব্যানারের ছড়াছড়ি। তাতে দুজন নেতার উপস্থিতিই বেশি। কোনোটায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান (শান্ত), কোনোটায় সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইকরামুল হকের (টিটু) পক্ষ থেকে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।
ময়মনসিংহ মহানগরের রাজনীতি এখন এই দুই নেতাকে কেন্দ্র করে দুটি ধারায় বিভক্ত। দুই পক্ষ আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করে।
মতিউর রহমানের সময়ে এখানকার রাজনীতিতে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। এখন নতুন রাজনীতি। আমরা সবাইকে নিয়ে কাজ করছি। মেয়র ও সাবেক মন্ত্রিপুত্রের মধ্যে সাংগঠনিক প্রতিযোগিতা নিয়ে দূরত্ব আছে।মোয়াজ্জেম হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, একসময় ময়মনসিংহ মহানগরে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের বড় ছেলে মোহিত উরের। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন। মতিউর রহমান মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর মোহিত উরের দাপট কমে গেছে। কেবল তা-ই নয়, শহরের শিববাড়ি এলাকায় মতিউর রহমানের বাড়ির কাছে দীর্ঘদিন ধরে জেলা আওয়ামী লীগের যে কার্যালয় ছিল, সেটাও আর নেই। নতুন কার্যালয় করা হয়েছে কালীবাড়ি এলাকায় মেয়র ইকরামুল হকের বাড়ির কাছে। একসময় মোহিত উরের সঙ্গে ছিলেন এমন অনেকে এখন ইকরামুলের পক্ষে ভিড়েছেন। এলাকায় পরিবহন খাত, বালুমহাল ও উন্নয়নকাজের দরপত্রসহ স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও অনেকাংশেই এখন মেয়র ইকরামুল ও তাঁর ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হকের (শামীম) হাতে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন মেয়রপক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মতিউর রহমানের সময়ে এখানকার রাজনীতিতে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। এখন নতুন রাজনীতি। আমরা সবাইকে নিয়ে কাজ করছি। মেয়র ও সাবেক মন্ত্রিপুত্রের মধ্যে সাংগঠনিক প্রতিযোগিতা নিয়ে দূরত্ব আছে।’
মতিউর রহমান ২০০৪ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। এরপর টানা এক যুগ সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে ধর্মমন্ত্রী হন। তখন ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের রাজনীতি, নিয়োগ-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, বালুমহালসহ বিভিন্ন খাত মন্ত্রিপুত্র মোহিত উর নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালে তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মতিউর রহমান আর মন্ত্রিত্ব পাননি। মূলত এরপর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়।
এর কয়েক বছর আগে থেকেই দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্রিয় হতে থাকেন ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে আসা ইকরামুল ও তাঁর ভাই আমিনুল। ২০১৯ সালের পর তাঁরা দুই ভাই মহানগর ও জেলা কমিটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। ইকরামুল মহানগর আর আমিনুল জেলা কমিটির সহসভাপতি পদে আছেন এখন।
ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মেয়র ও তাঁর ভাই রাজনীতিতে আবির্ভাবের পর থেকে এখন তাঁদের অবস্থান ভালো, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অঙ্গসংগঠনগুলো দুই গ্রুপে বিভক্ত অবস্থায় আছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগে মেয়র ও তাঁর ভাইয়ের অবস্থান হয়েছে। আগে মহানগর ছাত্রলীগে মোহিত উরের একটা অবস্থান ছিল, এখন সেটা নেই।
কার্যালয় সরানোয় অসন্তোষ
শিববাড়িতের দীর্ঘদিনের জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের পরিবর্তে মেয়রের বাড়ির কাছে কালীবাড়ি এলাকায় নতুন কার্যালয় করা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, শিববাড়িতে জেলা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যবাহী পার্টি অফিস। কেন এই কার্যালয় থেকে চলে গেল, সেটা বোধগম্য নয়। নতুন কার্যালয় মেয়রের বাসার কাছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এটা নিয়ে খুশি নন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, শিববাড়ির কার্যালয়টি মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় হিসেবে থাকবে। কালীবাড়ির কার্যালয়টি নিয়ে বিতর্ক থাকায় নতুন কার্যালয় করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
কোন্দল প্রকাশ্যে
জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আজহারুল ইসলাম। তিনি মোহিত উরের আত্মীয়। অন্যদিকে জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহরিয়ার মোহাম্মদ রাহাত খান একসময় মোহিত উরের সঙ্গেই ছিলেন, এখন মেয়রের লোক। মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক শাহিনুর রহমান মেয়রের পক্ষে আর যুগ্ম আহ্বায়ক রাসেল পাঠান মোহিত উরের পক্ষে আছেন।
দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা, আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখানকার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে।