লাখ লাখ টাকা আয়, তবু ধার-দানে নির্বাচন

ব্যবসা থেকেই বছরে ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এম আশরাফুল আলমের। পেশায় ব্যবসায়ী এই প্রার্থীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও রয়েছে কোটি টাকার ওপরে। অথচ সদ্য বিদায়ী এই কাউন্সিলর নির্বাচন করবেন দানের টাকায়। বাবা, শ্বশুর ও এক ব্যক্তির কাছ থেকে দান হিসেবে নেবেন তিন লাখ টাকা। বাকি এক লাখ টাকা নিজ থেকে খরচ করবেন।

নিজের খরচেই নির্বাচন করার সামর্থ্য আছে। তবে বাবা ও শ্বশুর টাকা দিচ্ছেন আমাকে উৎসাহ দিতে
কাউন্সিলর প্রার্থী এম আশরাফুল আলম

জানতে চাইলে এম আশরাফুল আলম বলেন, ‘নিজের খরচেই নির্বাচন করার সামর্থ্য আছে। তবে বাবা ও শ্বশুর টাকা দিচ্ছেন আমাকে উৎসাহ দিতে।’

আশরাফুলের মতো নির্বাচনী খরচের বিষয়ে আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করছেন অন্তত ৯৫ কাউন্সিলর প্রার্থী। ভাই-বোন, স্ত্রী, বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক, ভগ্নিপতিদের দান ও ধারের টাকায় নির্বাচনী ব্যয় মেটাচ্ছেন। আর নিজের টাকায় নির্বাচন করবেন ৫৬ প্রার্থী।

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ২৭ জানুয়ারি। ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে একটিতে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী। এক কাউন্সিলর প্রার্থী মারা যাওয়ায় বাতিল হয়েছে আলকরণ ওয়ার্ডের নির্বাচন। বাকি ৩৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৬৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫১ জনের হলফনামা বিশ্লেষণ করে ওপরের তথ্য পাওয়া গেছে।

তবে হলফনামায় দেওয়া নির্বাচনী ব্যয় ও সম্পদের উৎস নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হলফনামায় উল্লেখ করা প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় ও উৎস সম্পূর্ণ মনগড়া। তাঁরা বলেন, প্রার্থীরা হলফনামায় যেসব তথ্য দেন, তার কোনো সত্যতা বহন করে না। চাওয়ার খাতিরে চাওয়া হয়। দেওয়ার খাতিরে দেওয়া হয়। আর কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয় না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থীরা যে আয়ের হিসাব দেন, তা সঠিক কি না, যাচাই-বাছাই করে দেখবে এনবিআর। আর প্রার্থীরা যে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দেন, তা আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তা কমিশনের পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়।

এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে ব্যবসায়ী রয়েছেন ৭৩ জন, ঠিকাদার আছেন ২৬ জন, কমিশন ব্যবসায়ী আছেন ১৪ জন। এর বাইরে আইনজীবী, আড়তদার, কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, চাকরিজীবী প্রার্থীও এবার নির্বাচন করছেন। নির্বাচনে তাঁদের একেকজন সর্বনিম্ন দেড় লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন।

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, প্রার্থীরা পোস্টার, প্রচারপত্র ও ব্যানার ছাপানো, নির্বাচনী ক্যাম্প, বৈঠক, আপ্যায়ন ব্যয়সহ অন্তত ১৬টি খাতে টাকা খরচ করতে পারেন। নির্বাচনী হলফনামায় কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হয়। আবার এই টাকা কোথা থেকে আসবে, তারও উৎস জানাতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, প্রার্থীরা পোস্টার, প্রচারপত্র ও ব্যানার ছাপানো, নির্বাচনী ক্যাম্প, বৈঠক, আপ্যায়ন ব্যয়সহ অন্তত ১৬টি খাতে টাকা খরচ করতে পারেন। নির্বাচনী হলফনামায় কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হয়। আবার এই টাকা কোথা থেকে আসবে, তারও উৎস জানাতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।
২০১৫ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবার কাউন্সিলর হয়েছিলেন উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল আলম ওরফে জসিম। কাউন্সিলর হওয়ার পর তাঁর বার্ষিক আয় ও সম্পদ দুটিই বেড়ে যায়। বছরে তাঁর আয় হয় প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ আয় থাকার পরও নিজের ৫ লাখ টাকার নির্বাচনী ব্যয় নিজে মেটাতে পারছেন না। এর মধ্যে ধার হিসেবে এক লাখ টাকা দিচ্ছেন মালয়েশিয়াপ্রবাসী বোন। আরেক ব্যক্তি দান হিসেবে দিচ্ছেন এক লাখ টাকা। বাকি তিন লাখ টাকা নিজ পকেট থেকে খরচ করবেন।

টাকা থাকার পরও দান নেওয়ার বিষয়ে জহুরুল আলম বলেন, ‘আমার যা আয়, তা হলফনামায় দিয়েছি। নির্বাচনে অনেক খরচ। তাই বোন আর ঘনিষ্ঠ লোকজন টাকা দিচ্ছেন। তাঁদের তো না করতে পারি না।’

দক্ষিণ বাকলিয়ার সদ্য বিদায়ী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইয়াছিন চৌধুরীর বার্ষিক আয় ১০ লাখ টাকার ওপরে। এরপরও তিনি ধার ও দানের টাকায় নির্বাচন করবেন। সদ্য বিদায়ী আরেক কাউন্সিলর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের প্রার্থী আবদুল কাদেরের বার্ষিক আয় ২৮ লাখ টাকা। অথচ নির্বাচনী ব্যয় চার লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা দান হিসেবে নিচ্ছেন বোন ও ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তির কাছ থেকে। তিন লাখ টাকা নিজের পকেট থেকে খরচ করবেন। এলাকায় এক খুনের ঘটনায় এই প্রার্থী সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি আয় থাকার পরেও ধারদেনা ও দান-অনুদানের টাকায় নির্বাচন করবেন, এ রকম উল্লেখযোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে আছেন পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের শফিকুল ইসলাম, চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সদ্য বিদায়ী কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ, মোহরার মোহাম্মদ কাজী নুরুল আমিন ও মোহাম্মদ আইয়ুব আলী চৌধুরী, ফিরিঙ্গিবাজারের সাবেক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ ও দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম মো. চৌধুরী।

বছরে ৩০ লাখ টাকা আয় করেন পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী অনুপ বিশ্বাস। অথচ নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য হাত পেতেছেন শ্বশুরের কাছে। ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে ৫০ হাজার টাকা ধার হিসেবে নেবেন শ্বশুরের কাছ থেকে।

বছরে ১০ লাখ টাকার বেশি আয় থাকার পরেও ধারদেনা ও দান-অনুদানের টাকায় নির্বাচন করবেন, এ রকম উল্লেখযোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে আছেন পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের শফিকুল ইসলাম, চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সদ্য বিদায়ী কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ, মোহরার মোহাম্মদ কাজী নুরুল আমিন ও মোহাম্মদ আইয়ুব আলী চৌধুরী, ফিরিঙ্গিবাজারের সাবেক কাউন্সিলর হাসান মুরাদ ও দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম মো. চৌধুরী।

নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই-তৃতীয়াংশ প্রার্থী ধার ও দানের টাকায় নির্বাচন করলেও নিজের টাকায় নির্বাচনী ব্যয় মেটাবেন অন্তত ৫৬ প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন সদ্য বিদায়ী কাউন্সিলর। হলফনামায় এই রকমই তথ্য দিয়েছেন তাঁরা।

নগরের জালালাবাদ ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর মো. সাহেদ ইকবালের বার্ষিক আয় ২০ লাখ টাকা। তিনি নির্বাচনী ব্যয়ের ছয় লাখ টাকা নিজের পকেট থেকে খরচ করবেন। শুলকবহর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোরশেদ আলম বছরে আয় করেন ছয় লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকা নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য কারও কাছে হাত পাতছেন না তিনি। পশ্চিম বাকলিয়ার ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী এ কে এম আরিফুল ইসলামও নিজের টাকায় নির্বাচন করবেন। বছরে তাঁর আয় ৩০ লাখ টাকা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, হলফনামায় দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিশনের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে এলেও কোনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, যাচাই-বাছাইয়ে কমিশনের কোনো আগ্রহ নেই। অন্তত যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁদের হলফনামাগুলো যাচাই করতে পারে।