যোগ্য প্রার্থী থাকায় সরকার নারায়ণগঞ্জে প্রভাব বিস্তার করেনি
জয়ী হওয়ার মতো নিজেদের প্রার্থী থাকায় নারায়ণগঞ্জে সরকার প্রভাব বিস্তার করেনি বলে দাবি করা হয়েছে সিপিডি আয়োজিত সংলাপের মূল নিবন্ধে। এতে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠু নির্বাচন করায় সরকারের কোনো ঝুঁকি ছিল না। আইভীর জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল ছিল। হারলেও সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা দেওয়া যাবে।
‘সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন: জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক অনলাইন সংলাপে এমন কথা বলা হয়। আজ শনিবার এ সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। মূল নিবন্ধে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা দিলেও জনগণ তা বিশ্বাস করবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এমন বার্তা ২০১৩ সালেও পাঁচ সিটি নির্বাচনে সরকার দিয়েছিল। কিন্তু পরের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ।
সংলাপের মূল নিবন্ধে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে এখানে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে নানা ত্রুটি দেখা গেছে। আঙুলের ছাপ না মেলায় কেউ কেউ ভোট দিতে পারেনি। লম্বা সময় অপেক্ষা করে অনেকে ভোট না দিয়ে ফিরে গেছে। জালিয়াতির অভিযোগ উঠলেও তা যাচাই করার সুযোগ নেই। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইভিএমে করা উচিত হবে না।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে নানা মহলে অনেক প্রশ্ন আছে, যা কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা যায় না। এর মধ্যেই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে নারায়ণগঞ্জ। এতে সরকারের বিরুদ্ধে অতীতের অনেক অভিযোগ ভেসে যাবে। যারা মাঠের বাইরে থেকে পানি ঘোলা করতে চায়, তাদের মাঠে এনে খেলাকে শক্তিশালী করার জন্য নাগরিক সমাজকে ভূমিকা নিতে বলেন তিনি।
মন্ত্রী আরও বলেন, স্থানীয় সরকার উন্নয়নে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ আছে ঠিক, অনেকেই এতে অংশ নেয় না। আমলাতন্ত্রের কেন্দ্রেও এটি আছে। সরকারপ্রধানের নজরেও এটা আছে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, কোনো নির্বাচনেই ষড়যন্ত্রের বাইরে ছিলাম না, এবারও ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমার চেয়ে নির্বাচনে বেশি সুবিধা পেয়েছেন তৈমুর কাকা (তৈমুর আলম খন্দকার)। যদিও আমার দল ক্ষমতায়। আমার আস্থা ও ভরসার জায়গা জনগণ। তাদের নিয়েই লড়েছি। ইভিএম স্লো থাকায় অনেকে ভোট দিতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাবে সিটির উন্নয়ন করা যায় না। সরকার ছাড়া এটি সম্ভব হবে না।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, অর্থ, পেশিশক্তি ও ধর্মের ব্যবহার না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, যেটা নারায়ণগঞ্জে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনকে ব্যতিক্রমের মধ্যে না রেখে সব নির্বাচন এমন হওয়া উচিত। কার্যকর ইসি গঠনের জন্য আইনের মাধ্যমে ইসি নিয়োগ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকারকে কার্যকর হতে দেওয়া হয়নি। আমলাতন্ত্র কিছুতেই তাদের ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়।
আওয়ামী লীগের সাংসদ আরমা দত্ত বলেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমলাতন্ত্রের একটি সংঘাত সব সময় থাকে। এটি কমিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। তবে মাটি ও মানুষের সঙ্গে থাকলে শত বাধা সত্ত্বেও কাজ করা যায়, যা আইভী দেখিয়েছেন।
বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, ইভিএমে কারচুপি যাচাই করা যায় না। নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতা বলছে, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ নেই। দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের আশঙ্কা কম থাকায় জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার সুষ্ঠু ভোট দেখিয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা হবে না। ইসির চেয়েও সরকার গুরুত্বপূর্ণ। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু চাইলে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতে এটি দেখা গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের ভূমিকা আছে। সরকারের সঙ্গে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ইসিকে যৌথভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ একতরফা জয় পায়নি। বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির কারণে মেয়র পদে তাঁদের সবার ভোট পেয়েছেন আইভী। ইসি এখানে কিছু করেনি। দুই মূল মেয়র প্রার্থীর কারণেই ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। স্থানীয় সরকার উন্নয়নে করপোরেশন বা কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জয়ী হওয়ার মতো নিজেদের প্রার্থী থাকায় সরকারের সহযোগিতা ছিল। কোনো পক্ষ থেকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়নি। এমন পরিবেশ অন্য নির্বাচনে থাকবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। অন্য নির্বাচনে এমন ছিল না। জাতীয় সংসদে যদি সরকারের এমন ভূমিকা থাকে, তাহলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে নির্বাচন করতে পারবে ইসি।
সংলাপে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ইসি, সরকার, দল ও প্রার্থী চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, নারায়ণগঞ্জে এটি হয়েছে। খুলনা বা গাজীপুরের মতো নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হয়নি। এখানে ইভিএমে জালিয়াতি হয়েছে বলে বিশ্বাস করি না। তবে এটা যাচাইয়ের সুযোগ নেই। এটি একটি জঘন্য ইভিএম। ইসি যা তথ্য দেবে, তা–ই বিশ্বাস করতে হবে। আর ইসি তো প্রশ্নবিদ্ধ। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত হবে না, এটি জাতিকে আরও সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান।