বিএনপির বড় নেতাদের অনেকে কেন ছোট হতে চাইছেন

ফজলুল হক মিলন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী, আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির (ছবিতে বাঁ থেকে ডানে)

ইউনিয়ন থেকে থানা, থানা থেকে জেলা, জেলা থেকে কেন্দ্র। একজন রাজনৈতিক কর্মীর ধাপে ধাপে ওপরে ওঠার সিঁড়ি এটা। কিন্তু বিএনপিতে ঘটছে এর উল্টো ঘটনা। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছেড়ে গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি হলেন ফজলুল হক। জানা গেছে, একই পথে এগোচ্ছেন আরও বেশ কয়েকজন নেতা।

সাম্প্রতিক সময়ে জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসা দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আরও রয়েছেন যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দীন চৌধুরী, কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান ও  সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ এবং দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েও এসব কমিটির নেতৃত্বে এসেছেন। এর আগে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতির পদে থাকতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছেড়েছিলেন শাহাদাত হোসেন। তাঁদের মতো আরও অনেক নেতা এই তালিকায় রয়েছেন।

তবে বর্তমানে এ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন ফজলুল হক। দলের ভেতর-বাইরে নানা প্রতিক্রিয়া—ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সিঁড়ি বেয়ে মূল দল বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর কেন তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে আসন গাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন? প্রশ্ন উঠছে, বিএনপির বড় নেতারা কেন ছোট হতে চাইছেন?

‘স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব-প্রতিপত্তি’

কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে জেলার দায়িত্ব নেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল ফজলুল হকের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মফস্বলে দায়িত্ব পালন করেন, এটা হতেই পারে। যেমন আমাদের প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন, আবদুল মতিন চৌধুরীও নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ছিলেন। সবই সাংগঠনিক প্রয়োজনে। এটা সময়-কাল-পাত্র ভেদে প্রয়োজন হয়।’

তবে তাঁর ব্যাখ্যায় একমত হতে পারছেন না স্থানীয় বিএনপির নেতারা। গাজীপুর বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, রাজধানী ঢাকার অদূরের শিল্পাঞ্চল গাজীপুর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব-প্রতিপত্তির নানা হিসাব-নিকাশে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সহজে থানা ও জেলার নেতৃত্ব হাতছাড়া করতে চান না। কেন্দ্রীয় পদ ছেড়ে ফজলুল হকের জেলার সভাপতি হওয়ার পেছনে এটা একটি কারণ। এ ছাড়া নির্বাচনী এলাকায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চাওয়াও এখানে ভূমিকা রেখেছে।

ছাত্রদলের কর্মী হয়ে রাজনীতিতে আসা ফজলুল হক একসময় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি হন। এরপর জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক হন। স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শেষে তাঁকে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। একই সঙ্গে তিনি গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ও আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন। সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল সম্মেলনে গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন ফজলুল হক।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি হলে কেন্দ্রীয় পদ ছেড়ে দেবেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন শর্তে ফজলুল হককে সভাপতি করা হয়। কথামতো, তিনি কেন্দ্রীয় পদ থেকে ইস্তফা দিলে গত ২১ মে তাঁর শূন্য পদে আবদুস সালাম আজাদকে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।

কেন্দ্রের জন্য জেলার নেতৃত্ব ছেড়েছেন যাঁরা

বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১৫ (খ) অনুযায়ী, দলের স্থায়ী কমিটি বা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের কোনো সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটির কোনো কর্মকর্তা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক দলের অন্য কোনো পর্যায়ের কমিটিতে কর্মকর্তা নির্বাচিত হতে পারবেন না। তবে অনিবার্য কারণে দলের চেয়ারম্যান সাময়িকভাবে ব্যতিক্রম অনুমোদন করতে পারবেন।

২০১৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১৫ ধারায় বিশেষ বিধান ‘এক নেতা এক পদ’ যুক্ত করা হয়। গঠনতন্ত্রের ১৫-এর ‘ক’ ও ‘খ’ উপধারা মতে কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে দলের কোনো পর্যায়ের কমিটির শীর্ষ দুই পদে থাকতে পারবেন না। নতুন নেতৃত্বকে জায়গা করে দিতে দীর্ঘ দিন ধরে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ‘এক নেতা এক পদ’ কার্যকরের চেষ্টা করছিলেন। এ লক্ষ্যে দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গঠনতন্ত্রের এই ধারা কার্যকর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে এখন পর্যন্ত তা সেভাবে কার্যকর করা যায়নি।

অবশ্য ‘এক নেতা এক পদ’ কার্যকর করার নীতিগত সিদ্ধান্তের পর কেউ কেউ স্বেচ্ছায় একটি পদ ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বপ্রথম নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতির পদ ছাড়েন কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান। একইভাবে আরেক ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ (বর্তমানে স্থায়ী কমিটির সদস্য) সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ ছাড়েন। বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক হন। তিনি সহসাংগঠনিক সম্পাদকের পদটি ছেড়ে দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাধিক পদে আছেন, এমন নেতাদের একটি খসড়া তালিকাও তৈরি করা হয়েছিল। একই সঙ্গে দ্বৈত পদধারী ৫৫ নেতার কাছ থেকে পদত্যাগপত্রও সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে অনেক নেতা একসঙ্গে কেন্দ্রীয় ও জেলার গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী। তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক। একইভাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান সম্প্রতি টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হয়েছেন। রংপুর বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব লালমনিরহাট জেলা বিএনপিরও সভাপতি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, আমানউল্লাহ ও আবদুস সালাম ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের আরও অন্তত আটজন সদস্য আছেন, যাঁরা একসঙ্গে দুই পদে রয়েছেন। একইভাবে মানিকগঞ্জ জেলার সভাপতি আফরোজা খানম, মুন্সিগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আবদুল হাই, পাবনার আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান, চট্টগ্রাম উত্তর জেলার আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার, কুষ্টিয়া জেলার সভাপতি মেহেদি আহম্মেদও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন।

এ ছাড়া খাগড়াছড়ি জেলার সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, বান্দরবানের সভাপতি মা ম্যা চিং, চাঁদপুরের সভাপতি শেখ ফরিদউদ্দিন, মুন্সিগঞ্জের সদস্যসচিব কামরুজ্জামান, কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিনও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে আছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক নেতার এক পদ, এটি আমরা করছি। অনেকে দলের প্রয়োজনেই একাধিক পদে আছেন। এটা অনেক দিনের প্র্যাকটিস, তাই এটা উল্টাতে একটু সময় লাগছে।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এক নেতার এক পদ— এটা কার্যকর হচ্ছে। ইতিমধ্যে ফজলুল হক মিলন একটি পদ ছেড়ে দিয়েছেন। বাকিরাও ছাড়বেন, এটা হচ্ছে।

দল সিদ্ধান্ত দিলে কেন্দ্রের পদ ছাড়বেন খায়রুল কবির

গাজীপুরের পর গত ৩০ মে নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির এ কমিটির আহ্বায়ক। দলের ভেতরে আলোচনা আছে যে খায়রুল কবির যুগ্ম মহাসচিবের পদ ছেড়ে জেলার নেতৃত্বই বেছে নিতে পারেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুগ্ম মহাসচিবের পদ ছাড়তে হবে—এই শর্তে আহ্বায়ক হইনি। হ্যাঁ, দল যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেয়, তা মেনে নেব। আহ্বায়ক কমিটিকে সম্মেলন করার জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে। সম্মেলনের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের পদে থেকেও কেন জেলার নেতৃত্বে থাকছেন—প্রশ্নের জবাবে খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের লিডারশিপে ভ্যাকুয়াম (শূন্যতা) আছে। সরকারি দলের নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে আমরা তৃণমূলে ঠিকভাবে দল করতে পারিনি। এগুলো ঘুচিয়ে তারপর যাব। তা ছাড়া নেতা-কর্মীদের চাপের মুখে থাকতে হচ্ছে।’

জানা গেছে, স্থানীয় বিএনপিতে দ্বন্দ্ব প্রকট। এই মুহূর্তে নরসিংদী জেলা বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতার সঙ্গে খায়রুল কবিরের দ্বন্দ্ব চলছে। এ কারণে সেখানে কমিটি ঘোষণা দীর্ঘদিন আটকে ছিল। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের দুজনকে মূল দায়িত্বে রেখে নরসিংদীর কমিটি ঘোষণা করা হয়।

কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলার নেতৃত্বে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ। যাঁরা নির্বাচনকে ভিত্তি করে জনসম্পৃক্তির রাজনীতি করেন, তাঁদের জন্য কেন্দ্রীয় পদের চেয়ে জেলার পদ অনেক বেশি গুরুপূর্ণ।

এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘অনেকে তার সংসদীয় আসনটা ঠিকঠাক রাখতে চান। ওই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁরা বিষয়টি দেখেন। কিন্তু বড় নেতারা কেন ছোট পদে যান, এটি একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত। কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে তো আমি মন্তব্য করতে পারব না। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।’