বিএনপিকে বার্তা দিচ্ছে ইসি?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বাকি মাত্র তিন মাস। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী নির্বাচনে যাবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার করেনি। যদিও দেশের ভেতরে এবং বিদেশিরাও চান আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বা সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানে হোক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে তাঁরা কাজ করছেন।
নির্বাচন নিয়ে যখন নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে, দলগুলোও নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, তখন হঠাৎ করেই সামনে এসেছে আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধন থাকবে কি না। এই আলোচনার সূত্রপাত করেন নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ। তিনি সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, পরপর দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়বে। তবে তিনি এ–ও বলেন, নিবন্ধন বাতিল হবে কি না, সেটি একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এর কয়েক দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার বগুড়ায় এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বিএনপির নাম উল্লেখ করেই বলেন, পরপর দুবার নির্বাচনে না এলে বিএনপির নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি এ ব্যাপারে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশ্লিষ্ট ধারা ও নিবন্ধন বাতিলের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন।
আর এতেই চটেছেন বিএনপির নেতারা। তাঁরা বলছেন, ইসি সরকারের মুখপাত্রের মতো কথা বলছে। বিএনপির নিবন্ধন থাকবে কি থাকবে না, সেই ভয় দেখানোর দায়িত্ব ইসির নয়। ইসি যদি তাদের কাজটা করত, তাহলে তারা সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে আলাদাভাবে জানাতে পারত। তা না করে মাঠে বক্তব্য দিয়ে বিএনপিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা খুবই হাস্যকর।
অবশ্য শুধু বিএনপির নেতারাই নন, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, প্রচ্ছন্নভাবে নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে বার্তা দিয়ে দিচ্ছে, এবারের ভোটে না এলে দলটিকে সম্ভাব্য কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাঁরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন বারবার বলছে কোনো দলকে ভোটে আনার চেষ্টা তারা করবে না। তাই ভোটে নাএলে কী হতে পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক করার দরকারও তাদের নেই। কেননা রাজনৈতিক দলগুলো আরপিও সম্পর্কে ভালোই জানে। বরং কমিশনের এ ধরনের কথা সন্দেহ তৈরি করতে পারে, তারা সরকারের পক্ষ হয়ে বিএনপিকে একটা বার্তা দিয়ে দিচ্ছে। আইন দেখিয়ে ভোটে আনার চেষ্টা করছে।
অবশ্য নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইসি কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে এটি বলেনি। বরং দলগুলোকে বিষয়টি অবহিত করেছে। ভোটে আসা না–আসা দলগুলোর নিজস্ব বিষয়। তবে ওই কর্মকর্তা বলেন, সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে চিঠির মাধ্যমে এটি অবহিত করা হলে ভালো হতো। কেননা সরকারি দলের নেতারাও মাঠে এ ধরনের কথা বলছেন। ইসি বলায় এখন বিতর্ক হচ্ছে। এই কমিশনার বলেন, কমিশনের কোনো বৈঠকে নিবন্ধন–সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সিইসি ও ইসি সচিব এটা নিজ দায়িত্বে বলেছেন।
আইন অনুযায়ী এখন জাতীয় সংসদ ও সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশ নিতে হলে চাইলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত হতে হবে। যেসব দল নিবন্ধিত নয়, তাদের প্রার্থীরা মূলত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নিতে পারেন, দলগত ভাবে পারেন না। বাংলাদেশে এখন ৪০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মনে করেন, ‘বিএনপি নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়বে’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কথা বলে বিএনপিকে ভয় দেখাচ্ছেন, যাতে বিএনপি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে একতরফা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তিনি বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি, এই কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। সিইসি ও সচিবের বক্তব্য প্রমাণ করে কমিশন সরকারের হয়ে কাজ করছে। কখনো কখনো বিরোধীদের মোকাবিলায় সরকারের শিখিয়ে দেওয়া কথা দলীয় মুখপাত্রের মতো বলে চলছেন।’
বিএনপি যদি নিবন্ধন হারায় তাহলে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষমতা যেমন নির্বাচন কমিশনের তেমনি তাদের বাতিলের ক্ষমতাও রয়েছে।
নির্বাচনী আইন আরপিওর ৯০ (এইচ) (ই) ধারায় বলা হয়েছে, ৫ কারণে একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ইসি বাতিল করতে পারবে। এর মধ্যে আছে ১. যদি দলটি নিজেই নিজের বিলুপ্ত ঘোষণা করে। ২. সরকার যদি কোনো দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ৩. কোনো নিবন্ধিত দল যদি পরপর তিন বছর নির্বাচন কমিশনের চাহিদামতো তথ্য দিতে না পারে। ৪.৯০ (বি) অনুযায়ী নিবন্ধন পাওয়ার ও রাখার শর্ত ভঙ্গ করে। এবং ৫. কোনো দল যদি পরপর দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়।
তবে এই আইন অনুযায়ী দুবার অংশ না নেওয়া দলের নিবন্ধন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ হবে না। কমিশন দলকে শুনানির জন্য সুযোগ দেবে।
বিএনপিসহ ২৮টি রাজনৈতিক দল ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। অংশ নিয়েছিল ১২টি দল। বিএনপি ছাড়াও সিপিবি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, এলডিপি ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ফলে এই দলগুলো একাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে তাদের নিবন্ধনও ঝুঁকিতে পড়বে। তবে তার আগে কেন নির্বাচনে যায়নি, সে ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহম্মদ ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধন সরাসরি বাতিল হওয়ার বিধান রাখা হয়নি। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে যদি সংশ্লিষ্ট দলের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলেই কেবল ইসি তা বাতিল করতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই বক্তব্য হয়তো কিছু দলের কাছে সন্দেহের সৃষ্টি করছে। কিন্তু বিষয়টি আইনগত। ফলে সবকিছুই আইনিভাবেই মোকাবিলা করতে হবে।