জোটের রাজনীতি
বিএনপি ভোটে না গেলে ১৪ দল কী করবে
নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে জোটগতভাবে ভোট করবে ১৪ দল। বিএনপি ভোট বর্জন করলে শরিকেরা আলাদা নির্বাচন করতে পারে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৪-দলীয় জোটকে আস্থায় রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য দেড় বছরের বেশি সময় বাকি থাকতেই জোটের শরিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগামী নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ। এর পেছনে দুটি কৌশল কাজ করেছে। প্রথমত, শরিকদের কেউ বিরোধী জোটে যাতে ভিড়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়ত, বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলে শরিকদের আলাদাভাবে ভোট করানোর কৌশল নেওয়া যাবে।
১৪-দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং অন্য শরিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় তিন বছর পর গত ১৫ মার্চ ১৪ দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন জোটের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শরিকদের আশ্বাস দেন, আগামী নির্বাচনে জোটগতভাবেই অংশ নেবেন। এরপর ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও জোটগতভাবে ভোটে অংশ নেওয়ার কথা জানান শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ১৪ দলের বাইরে বাম ঘরানার অন্য দলগুলোকেও জোটে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।
জোটগতভাবে ভোটের আশ্বাস পেয়েছেন তাঁরা। তবে ভোটের আগে আরও অনেক রাজনৈতিক বিষয় সুরাহা করতে হবে।রাশেদ খান মেনন, ১৪ দলের শরিক ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি
সেটা সম্ভব না হলে নির্বাচনী সমঝোতার মাধ্যমে তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে ক্ষমতাসীনেরা। পাশাপাশি বিএনপিসহ বিরোধীরা ভোট বর্জন করলে তারা যাতে নির্বাচনে অংশ নেয়, সেটাও নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার সমালোচনা এখনো শুনতে হচ্ছে সরকারকে। এবার আর এমনটা চায় না আওয়ামী লীগ।
তবে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে জোটগত ভোটের আশ্বাস পেলেও সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয় কিংবা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শরিকদের অংশগ্রহণ নেই। এ ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলে কী পরিস্থিতি হবে—এ বিষয়ে এখনো আওয়ামী লীগ শরিকদের স্পষ্ট করেনি। শেষ মুহূর্তে শরিকদের বিরোধী দলের ভূমিকা নেওয়ার কথা বললে করণীয় কী হবে, সেটাও ভাবছে তারা। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজ নিজ দল শক্তিশালী করার বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন। জোটগত ও আলাদা ভোট—দুই পরিস্থিতির কথাই তাঁদের বিবেচনায় আছে।
১৪ দলের সূত্র জানায়, জোটগত ভোটের আশ্বাস পেলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সরকারের দুর্নীতি নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত রাখবেন তাঁরা। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করার বিষয়েও জোটের শরিকেরা বক্তব্য দেবেন সামনের দিনগুলোতে। আলাদা ভোট করা কিংবা প্রয়োজনে জোট ছাড়তে হলে যাতে বিরোধীদের কাছেও গুরুত্ব পাওয়া যায়, সেটা বিবেচনায় নিয়েই এ কৌশল নিয়েছেন শরিকেরা।
তবে বিএনপিসহ সব দলই ভোটে অংশ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ জোটগতভাবেই ভোটে অংশ নেবে। আর বিএনপি বর্জন করলে কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
আ.লীগ যে কারণে জোট অটুট রাখতে চায়
আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা জোট সম্প্রসারণ ও কর্মসূচিভিত্তিক মিত্র তৈরির চেষ্টা করছে। অন্যদিকে একসঙ্গে ভোট করলেও বর্তমান সরকারে ১৪ দলের শরিকদের কোনো অংশীদারি নেই। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর জোটের রাজনৈতিক কার্যক্রমও প্রায় স্থবির। ফলে শরিকেরা নির্বাচনী ব্যবস্থা, অনিয়ম, সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। এ পরিস্থিতিতে শরিকদের কেউ কেউ বিরোধী জোটের দিকে যায় কি না, এ শঙ্কা দেখা দেয় আওয়ামী লীগে।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, ১৪ দলের শরিকদের বেশির ভাগেরই সাংগঠনিক শক্তি বলার মতো নয়। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে এই শরিকদের গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন ১৪ দলের শরিক প্রায় সব দলই প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে। অধিকাংশ দল পুরোনো এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনে তাদের গুরুত্ব আছে।
বিএনপি বর্জন করলে যা হতে পারে
১৪ দলের শরিকেরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করতে পারে—এমন ভাবনা নিয়ে আলোচনা আছে। কারণ, এবার ভোট বর্জন করলেও দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার আশঙ্কা নেই। এ পরিস্থিতিতে সরকারের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। প্রথমত, নিজেদের জোট ঠিক রাখা। দ্বিতীয়ত, বেশিসংখ্যক দলকে ভোটে আনার চেষ্টা করা।
১৪ দলের শরিক একটি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন এখনো অনেক দূরে। এর মধ্যে অনেক কিছুই হতে পারে। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল ভোট বর্জন করলে দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো নির্বাচনকে কীভাবে দেখে, সেটা একটা বড় বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
জোটের শরিক আরেকটি দলের দায়িত্বশীল নেতা বলেন, সাত বছর আন্দোলন করেও স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন হয়নি। তবে শেষ দিকে অল্প সময়ে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়, এরশাদের পতন হয়। শ্রীলঙ্কায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজাপক্ষে সরকার টিকতে পারেনি। এক মাসের মধ্যে রাজাপক্ষে সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনের আগে রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটা এখনই বলা যাবে না।
জোট সম্প্রসারণ, নির্বাচনকালীন সরকার ও আসন বণ্টন
১৪ দলের শরিকদের সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভেতরে-ভেতরে জোট সম্প্রসারণের চেষ্টা আছে। এটা জোটের শরিকদের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। এর বাইরে ভোটের আগে নির্বাচনকালীন সরকার হবে। সেখানে জোটের শরিকেরা থাকবে কি না, এটাও স্পষ্ট নয়। গত তিনটি নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিলেও ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও তরীকত ফেডারেশনের বাইরে অন্য দল থেকে কেউ মনোনয়ন পাননি। এমন পরিস্থিতিতে শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাসদ জোট থেকে প্রায় বের হয়ে গেছে। তারা এখন আর জোটের কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে না। আগের তিনবার বঞ্চিত ব্যক্তিরা এবার মনোনয়নের আশায় আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সরকারে জোটের শরিকদের স্থান না দেওয়ায় তাঁরা অসন্তুষ্ট। আগামী নির্বাচনে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। জোট টিকিয়ে রাখাও জরুরি।
১৪ দলের শরিক ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, জোটগতভাবে ভোটের আশ্বাস পেয়েছেন তাঁরা। তবে ভোটের আগে আরও অনেক রাজনৈতিক বিষয় সুরাহা করতে হবে। তিনি জানান, ভোট যেভাবেই হোক, তাঁরা দল শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছেন।