২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বছর শেষে নড়াচড়া বিএনপির

২০২১ সাল দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কীভাবে পার করল, এই দুই প্রতিবেদনে রয়েছে তারই পর্যালোচনা।

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য এত দিন কিছু করতে না পারলেও চলতি বছরের শেষ দিকে এসে নড়েচড়ে উঠেছে বিএনপি। এখন দলটির সব ব্যস্ততা হাসপাতালে শয্যাশায়ী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি অনেকটাই নীরব হয়ে পড়েছিল। গত সেপ্টেম্বরে দলটির এই নীরবতা ভাঙে। এরপর খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ১৯ নভেম্বর তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি, যা এখনো চলছে। এর মধ্য দিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সক্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন দলের নেতারা।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সাল বিএনপির জন্য সংকটপূর্ণ গেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তিনি এখনো বন্দী অবস্থায় আছেন। তাঁর মুক্তির জন্য কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।

সামনে আছে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব যথেষ্ট দোটানায় আছে। এ বিষয়ে জনমত তৈরি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো দৃঢ়তা পুরোনো নেতাদের মধ্যে নেই। আবার নতুন নেতৃত্বের মধ্যেও সৃষ্টিশীল কিছু দেখছি না
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী

গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ দিনে দলের নেতা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে ৪৫ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার সভা করে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এটি ছিল দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রথম এবং বড় আকারের সাংগঠনিক সভা। এর আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হয় দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে। এ কারণে বিএনপির প্রায় সাড়ে পাঁচ শ সদস্যের নির্বাহী কমিটির সভার গুরুত্ব বেড়ে যায়।

এ ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাঁর সভাপতিত্বে কয়েক ধাপে নির্বাহী কমিটির এ সভাটি হয়। ১০ দিনের ধারাবাহিক সভাগুলো ছিল এ বছরে বিএনপির জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ, এসব সভা দীর্ঘদিন ধরে চুপ থাকা দলে কিছুটা চাঙা ভাব তৈরি করেছে।

মির্জা ফখরুল ইসলামের মতে, এ বছর সাংগঠনিকভাবে বেশ ভালো কাজ হয়েছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাটি। যেখানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে দলের নেতারা দীর্ঘ সময় মতবিনিময় করেন। এটি একটি বড় কাজ হয়েছে। এতে দলে গতি সৃষ্টি করেছে।

খালেদা জিয়া
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

যদিও দল পুনর্গঠন নিয়ে এখনো হতাশা রয়ে গেছে বিএনপিতে। কারণ, কয়েক বছর ধরে চলা দল পুনর্গঠন এখনো শেষ হয়নি। পুনর্গঠন চলেছে এ বছরও। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত ৫৫টিতে কমিটি করা গেছে। এর মধ্যে চলতি বছরে ৩০ জেলায় কমিটি হয়। এ ছাড়া জাতীয়তাবাদী কৃষক দল ও জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) নতুন কমিটি হয় এ বছর। সারা দেশে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। মহিলা দলের জেলা কমিটি গঠনও অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে বিএনপিসহ সব অঙ্গসংগঠনকে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যা কেউই করতে পারেনি।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০২১ সালে বিএনপিতে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল মহানগর কমিটি পুনর্গঠন। ঢাকায় আমানউল্লাহকে মহানগর উত্তর এবং আবদুস সালামকে দক্ষিণের আহ্বায়ক করে কমিটি দেওয়া হয়। সব মহানগরেই নেতৃত্ব থেকে পুরোনোরা বাদ পড়েন। এর মধ্যে বরিশালে মজিবর রহমান (সরোয়ার), খুলনায় নজরুল ইসলাম (মঞ্জু), রাজশাহীতে মোসাদ্দেক হোসেনের (বুলবুল) বাদ পড়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে দলে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নতুন কমিটিগুলোতে মাঠের পরীক্ষিত কর্মী, বিশেষ করে জিয়া পরিবারের প্রতি আনুগত্য দেখেই পদ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলে নানা প্রতিকূলতার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূল দল বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হচ্ছে। ঢাকা মহানগরের থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট গঠনেও এ প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা জানান ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঠের পরীক্ষিতরা কমিটিতে আসবে। বিশেষ করে জিয়া পরিবারের প্রতি আনুগত্য রাখেন, এমন নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বের জন্য বাছাই করা হবে।’

এ ছাড়া চলতি বছর বিএনপিকে দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে তৎপর দেখা যায়। এর মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে তাঁর একটি বক্তব্যের বিষয়ে চাওয়া ব্যাখ্যা, ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।

মির্জা আব্বাস দলীয় এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘আমি জানি, আওয়ামী লীগ সরকার ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি। তাহলে গুমটা কে করল। এই সরকারের কাছে এটা আমি জানতে চাই।’ এ বক্তব্য দলকে বিব্রত করে।

এ ছাড়া দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শফি আহমেদ চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কার, নজরুল ইসলামকে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে, আর মনিরুল হককে (কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র) নির্বাহী কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। শফি আহমেদ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মনিরুল হক দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, সর্বশেষ চিঠি পেয়েও দলের নির্বাহী কমিটির সভায় উপস্থিত হননি। আর নজরুল ইসলামকে অব্যাহতি দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলন করে নবগঠিত খুলনা মহানগর কমিটির ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্যের জন্য।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সালে দলের বাকি পুনর্গঠন শেষ করার পাশাপাশি আন্দোলনের কাঠামো তৈরিতে মনোনিবেশ করবে। তবে দল গোছানো, আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির যে লক্ষ্যের কথা তারা বিভিন্ন সময়ে বলেছিল, সেটার কোনোটিতেই বিএনপি সফল হয়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২০২১ সালে অনেক ইস্যুই এসেছিল, কোনোটিতে বিএনপিকে সেভাবে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ‘সামনে আছে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব যথেষ্ট দোটানায় আছে। এ বিষয়ে জনমত তৈরি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো দৃঢ়তা পুরোনো নেতাদের মধ্যে নেই। আবার নতুন নেতৃত্বের মধ্যেও সৃষ্টিশীল কিছু দেখছি না।’