জামায়াতের 'চিন্তা' জানে না বিএনপি
রাজনীতিতে বিএনপির দুই দশকের সঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী তাঁদের সঙ্গ ছাড়ার কথা ভাবছে। গত জানুয়ারি ও চলতি মাসে দলটির কয়েকটি বৈঠকে নেতারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়ার ব্যাপারে মতামত দেন বলে জানা গেছে। তবে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী জোট ছেড়ে যেতে পারে—এমন কোনো তথ্য বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর কাছে নেই।
চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি এবং ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতের মজলিশে শুরার বৈঠক হয়। সেখানে বিএনপিকে ছাড়ার ব্যাপারে আলোচনা হলেও দলটি এ ব্যাপারে তাদের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি বা ২০ দলের শরিকদের কিছুই জানায়নি। এই বৈঠকগুলোয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতের যাত্রা করার বিষয়েও আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে গঠনতন্ত্রে সংশোধনীও আনা হয়েছে।
জোটের শরিকেরা বলছেন, এই মুহূর্তে ২০ দল সেভাবে কার্যকর নেই। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জোটের দুটি বৈঠক হয়েছে। প্রথম বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি তোলা হয়। আর দ্বিতীয় বৈঠকে মূলত উপজেলা ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। শরিকেরা বলছেন, বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে মিলে কিছু কর্মসূচি পালন করছে। এখানে ২০ দলের কোনো অংশগ্রহণ নেই।
গত জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর দুই দফা বৈঠকে প্রায় দুই দশকের জোটসঙ্গী বিএনপিকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়—এমন খবর পাওয়া যায়। যদিও প্রকাশ্যে জামায়াতের নেতারা তা স্বীকার করছেন না। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, এ বিষয়ে তাঁরা অন্ধকারে। নির্বাচনের পরে ২০ দলের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে জামায়াত এমন কোনো আভাস দেয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিএনপি থেকে ২০ দলের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান জামায়াত ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এটা গণমাধ্যমেই জেনেছি। তারা আমাদের কিছু জানায়নি। বিএনপি থেকে আমরা কিছু জানি না।’
এই জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থও জানান, এ বিষয় নিয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। তিনি আরও বলেন, এটা জোটে আলোচনা করে কিছু হবে না। এই জোট বিএনপিকেন্দ্রিক। সবার ঐক্য বিএনপির সঙ্গে। জামায়াত থাকা না থাকায় জোটে খুব একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন না বিজেপি চেয়ারম্যান।
খালেদা জিয়া গত বছর জেলে যাওয়ার পর থেকেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব শুরু হতে থাকে। গত বছর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সিলেটে আলাদা প্রার্থী ঘোষণা করায় তা প্রকাশ্যে দেখা যায়। এ ছাড়া বিএনপিও তেমন কোনো আন্দোলন বা ২০ দলকে সঙ্গে নিয়ে তেমন কিছু করেনি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ২০ দলও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। সেখানে আসন বণ্টন নিয়ে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দর-কষাকষি চলে। মনের মতো আসন না পাওয়ায় জামায়াত তখন মনঃক্ষুণ্ন হয়। বিএনপি নির্বাচন বয়কট না করলেও ৩০ তারিখ দুপুরেই জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে তাঁদের নানান বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কিছুরই সিদ্ধান্ত হয়নি। এ ছাড়া বলেন, তাঁদের এ জোট মূলত নির্বাচনী জোট। নির্বাচন ঘিরে তাঁদের জোটভুক্ত কার্যক্রম হয়। এখন যেহেতু কোনো নির্বাচনে কেউ যাচ্ছে না। তাই জামায়াত নিজেদের দলের ব্যাপারে প্রাধান্য দিচ্ছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর ২০ দলকে তেমন পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না অভিযোগেও শরিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। এ ছাড়া নির্বাচনের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা, এমনকি আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী বিএনপির টিকিট পাবে জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের অংশ হতেন না। যদিও একই প্রতীকে তাঁরা নির্বাচন করেও জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা নেই বলে জানান।
২০–দলীয় জোটের আরেক শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও জামায়াত নতুন নামে দল গঠন করবে, তা আমরা শুনেছি। তারা হয়তো সে প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে তারা ২০ দলে থাকতেও পারে, নাও পারে।’ তাঁর মতে, জামায়াত যা–ই করুক, সবকিছু বিবেচনা করে যেন সিদ্ধান্ত নেয়।
যুদ্ধাপরাধী দল এবং এই দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। যুদ্ধাপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে কয়েক নেতারা। সাজার রায় নিয়ে আবার বিচার চলার কারণে জেলে আছেন অনেকেই। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ব্যাপক বিজয় পায়। এ কারণে একত্রে সরকারও গঠন করে তারা। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই জোটের ভরাডুবি হয়। এরপর থেকে জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে বিএনপির ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে জামায়াত দেশে ব্যাপক সহিংসতা চালায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন রুখতে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা ব্যাপক মাত্রা পায়। ভোট ঠেকাতে না পেরে এবং ২০১৫ সালে সরকার পতনের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে দলের শুভাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধিজীবীরা চাপ দিতে থাকেন। তবে বিএনপি তার এই রাজনৈতিক মিত্রকে ছাড়তে চায়নি।
বিএনপির নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারাও বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলেন। জামায়াত ছাপার চাপ প্রসঙ্গে গত ১৩ জানুয়ারি প্রথম আলোকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন তাঁর দলের কথা বলেছেন। আমরা (বিএনপি) এখনো এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করিনি। শরিকেরা কী চান না চান, সেটা এখনো আলোচনাই হয়নি।’
বিএনপির এই দলীয় অবস্থানের মধ্যে জামায়াত বিএনপি ছেড়ে যাচ্ছে—এমন সংবাদে ‘খুশিই’ হয়েছেন বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী এবং দলটির অনেক নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমন খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, জামায়াত এই সিদ্ধান্ত নিলে ভালোই হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেছেন, জামায়াত বিএনপিকে ছাড়ার ব্যাপারে দলটির মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, তা তিনি জানেন না। তবে জামায়াত এমন সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপির জন্য ভালোই হবে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই মনে করি, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট থাকা উচিত না।’