জটিল পরিস্থিতির মুখে জাতীয় পার্টি

আগামী জাতীয় সংসদেও প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা বা অবস্থান ধরে রাখতে চায় জাতীয় পার্টি (জাপা)। এই লক্ষ্যেই এগোচ্ছেন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে দলটির নেতারা বলছেন, গত দুই নির্বাচনে জাপা যে সুবিধাগুলো পেয়েছিল, আগামী নির্বাচনে তা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ এবং দলটির ওপর সরকারের প্রভাব—সব মিলিয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে জাপা।

এ অবস্থায় এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার নেতৃত্বে আসা জি এম কাদের ‘সাচ্চা’ বিরোধী দলের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান।

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই সন্দিহান হওয়ার কারণ মূলত দুটি। একটি হচ্ছে জাপার বিরোধী দল হওয়া বা সরকারবিরোধী ভূমিকা এখনো মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, জাপার বর্তমান নেতৃত্ব সত্যিকারের বিরোধী দল হওয়ার যে চেষ্টার কথা বলছেন, তা শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, সেটিও অনিশ্চিত। এর একটি কারণ, দলে যে চাপা বিরোধ রয়েছে, সেটি আগামী নির্বাচনের আগে বড় হয়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন
এইচ এম এরশাদ, রওশন এরশাদ, জি এম কাদের

এরই মধ্যে এরশাদ–পত্নী ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদকে ঘিরে দলের ছোট একটি অংশ তৎপর হয়েছে। অন্যদিকে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক ‘জাতীয় পার্টি’ নামেই আলাদা তৎপরতা শুরু করেছেন। এই দুই তৎপরতার নেপথ্যে বিশেষ মহলের উৎসাহ রয়েছে বলে মনে করছেন জাপার নীতিনির্ধারকেরা। জি এম কাদেরের চেয়ে রওশনের ওপর সরকারের শীর্ষ মহলের আস্থা বেশি বলে দলে আলোচনা আছে। এ ছাড়া দলের যে ২৬ জন সাংসদ আছেন, তাঁদের অনেকে দলের চেয়ে সরকারের সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন বলে দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে।

এদিকে রওশন এরশাদ অসুস্থ হয়ে পাঁচ মাসের বেশি সময় ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। পায়ের সমস্যার কারণে হাঁটাচলা করতে পারেন না। ব্যাংককে তাঁর সঙ্গে ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদও আছেন।

আরও পড়ুন

রওশন এরশাদ গত মঙ্গলবার ব্যাংকক থেকে টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, দেশে ফিরে তিনি জাতীয় পার্টির হাল ধরার চেষ্টা করবেন। দলের কিছু নেতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে বলেও জানান।

রওশন এরশাদ ব্যাংককে থেকেই ১১ এপ্রিল সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহকে সংসদে বিরোধী দলের নেতার রাজনৈতিক সচিব পদে নিয়োগ দেন। এটাকে রওশনের সঙ্গে ভেতরে-ভেতরে দলের একটি পক্ষের তৎপরতার আভাস বলে মনে করছেন জাপার দায়িত্বশীল নেতারা।

রংপুর সদর আসনের জাপার সাংসদ ও রওশন এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদ মনে করেন, এখনো তাঁর মায়ের পক্ষে দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব।

জাপার উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তঁারা আঁচ করতে পারছেন যে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার বর্তমান ভূমিকা সরকারের উচ্চ মহলের পছন্দ নয়। এর কিছুটা প্রকাশও পেয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের গত অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে সরকারের ‘একনায়ক’ হয়ে ওঠা নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন জি এম কাদের, যা সরকারি দলের বিরক্তির কারণ হয় বলে জানা গেছে।

অবশ্য এ বিষয়ে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো আমাদের কাছে নতুন বিষয় নয়। যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তখনো তারা জাতীয় পার্টিকে হাতের মুঠোয় নিতে চেয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমরা স্বাধীন সত্তা নিয়ে থাকতে চাচ্ছি, পোষা কুকুর হয়ে থাকতে রাজি নই। আমাদের মধ্যে যারা পোষা কুকুর হতে চায়, তাদের একটা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সামনে বাড়ানোর চেষ্টা হতে পারে। আমরা ধরেই নিয়েছি যে এ ধরনের কিছু একটা হতে পারে। এটার জন্য আমরা প্রস্তুত।’

সরকারের দোষত্রুটি ধরে জাতীয় সংসদে শক্তভাবে কথা বলছেন জাপার নেতারা। জাতীয় সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনেও দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি ও সরকারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের উপলব্ধি হচ্ছে, আগামী সংসদ নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে অনেক কিছু ঘটতে পারে। এ অবস্থায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সব মনোযোগ আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য রাজনৈতিক মেরুকরণ নিয়ে।

তবে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের লক্ষ্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিহিংসার রাজনীতির বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করা। এটাকে লক্ষ্য ধরে দেশের সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা ও ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান মুজিবুল হক।

জাপার শীর্ষ নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে এবং বিএনপিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। এ নির্বাচনে মূলত দুটি রাজনৈতিক জোট থাকবে। এর একটি হবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, আরেকটি হবে বিরোধীদের। এই মেরুকরণে জাপা কোন দিকে যাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এ বিষয়ে দলটির প্রধান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আমরা দেখব, দেশের জনগণের প্রত্যাশা কী।’