ছাত্রলীগের নেতৃত্ব: টাকার ভাগ নিয়ে যত ঝামেলা

ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগ

চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা আর টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন ছাত্রলীগের আয়ের প্রধান উৎস। অভিযোগ আকারে বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে এলেও এবার ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতৃত্ব সেটাই প্রমাণ করলেন। এসব অভিযোগে এবার তাঁদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।

৮ সেপ্টেম্বর রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ সভায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতারা গণমাধ্যমকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন। এরপর ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী দুদিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও ফিরে আসেন।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার গোলাম রাব্বানী ক্ষমা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন। চিঠিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থেকে টাকা চাওয়ার অভিযোগ ও গুলিস্তানের কার্যালয়ের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি। ২০ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে দেরি করে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। রাব্বানী দাবি করেন, তাঁরা বারবার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন।

জানা গেছে, কমিটি বাণিজ্য আর মাদক ছাড়াও ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ হওয়ার বড় কারণ হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বড় অঙ্কের টাকা চাওয়ার যে অভিযোগ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে, তাতেও ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগাতে অর্থ লেনদেনের বিষয় এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রলীগের অফিস কক্ষে মাদক পাওয়ার বিষয়টি।

গত ১৩ মে সম্মেলনের এক বছরের মাথায় ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করেন ছাত্রলীগ সভাপতি–সাধারণ সম্পাদক। এরপর থেকেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ না পাওয়া নেতারা আন্দোলন শুরু করেন। অভিযোগ ওঠে, অর্থের বিনিময়ে যোগ্যদের বাদ দিয়ে মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিবির ও ছাত্রদলের নেতাদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান সেই আন্দোলনের রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন বিতর্কে জড়ালেন দুই শীর্ষ নেতা।

প্রধানমন্ত্রী কেন ক্ষুব্ধ সে বিষয়ে সভাপতি রেজওয়ানুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুঝতে পারছি না। তবে আমার ধারণা, নেত্রী খুব কষ্ট পেয়েছেন। আমাদের কাছে যেটা যেভাবে চেয়েছিলেন, সেটা সেভাবে পাননি হয়তো। ভালো ছাত্রের প্রতি যেমন শিক্ষকের প্রত্যাশা বেশি থাকে, আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।’ 

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজে টাকা দাবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, তাদের কাছ থেকে বরাদ্দের ৪ থেকে ৬ শতাংশ নিয়ে ছাত্রলীগকে দেওয়ার দাবি করেছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক—এমন অভিযোগ তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তিনি এ অভিযোগ জানিয়েও এসেছেন। তবে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর দাবি, কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সঙ্গে উপাচার্যের ছেলে ও স্বামীর এই লেনদেন হয়েছে।

উপাচার্য ফারজানা ইসলাম গতকাল প্রথম আলোর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে ইতিমধ্যে জানিয়েছি যে তারা আমাকে হুমকি–ধমকি দিয়েছে। এই হুমকিরই একটি প্রকাশ হিসেবে এখন আমার স্বামী ও ছেলের ওপর দোষ দিতে চাচ্ছে। তারা মনে করেছে, এতে আমি ভয় পাব। কিন্তু এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা। টাকা লেনদেনের বিষয়ে আমার ও আমার পরিবারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’

গত মে মাসে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছয়টি আবাসিক হল নির্মাণের জন্য ৪৫০ কোটি টাকার দরপত্রের শিডিউল বিক্রির সময় উপাচার্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ছিলেন। সে সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে উপাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে আমি জীবন–মরণ লড়াই করছিলাম। সেখানেও তারা এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিল। তারা হাসপাতালেও গেল, বাসায়ও এল। কিন্তু তাদের প্রস্তাব আমি কখনোই শুনব না। তাদের কথা না মানায় তারা অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গিয়েছিল।’

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘পার্সেন্টেজ চাওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। আমরা জানতে পারলাম, আমাদের নলেজের বাইরে ছাত্রলীগকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের সব সাংগঠনিক ইউনিটকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেত্রী আমাদের দিয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে নেতিবাচক খবর হলে তার দায়ভার আমাদের ওপরও বর্তায়। তখন আমি ও সভাপতি উপাচার্য ম্যামকে জিজ্ঞেস করি তিনি টাকা কেন দিলেন, নিশ্চয়ই আপনার বা আপনার ঘনিষ্ঠ কারও সংশ্লিষ্টতা আছে! এ কথাটিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন।’

গোলাম রাব্বানীর দাবি, উপাচার্যের স্বামী ও ছেলে এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর ভাষ্য, ‘উপাচার্যের স্বামীর কোনো পেশা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটাজের মতো বিষয়গুলোই দেখে থাকেন। উপাচার্যকে আমরা বলেছিলাম, টাকা দিতে হলে আপনি আমাদের মাধ্যমে বলতেন।’

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। গতকাল বিকেলে শাখা ছাত্রলীগের উপ–দপ্তর সম্পাদক এম মাইনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গোলাম রাব্বানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সম্পর্কে যে বিবৃতি দিচ্ছেন, তা সম্পূর্ণ অসত্য। গত ৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আলোচনার বিষয়ে তাঁরা অবগত ছিলেন না।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি নিয়ে বাণিজ্য

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান,বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত জেলা সমমর্যাদার দুটি কমিটি ঘোষণা করেছে। এর একটি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি। গত ১৩ জুলাই ঘোষণার পর থেকেই কমিটি দিতে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামের সঙ্গে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কথোপকথনের ফাঁস হওয়া একটি অডিওতে তার সত্যতাও পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ মিনিটের ফাঁস হওয়া অডিওতে নেতা হওয়ার জন্য টাকার দেনদরবার, কমিটি ভাঙা ও নতুন কমিটি আনাসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।

তবে অডিওর বিষয়টি অস্বীকার করে রাকিবুল ইসলাম দাবি করেন, ‘ওই কণ্ঠ আমার নয়। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি।’

ছাত্রলীগের একটি সূত্র বলছে, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা তাঁর পছন্দের ব্যক্তিকে শীর্ষ দুটি পদের একটি দিতে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তা না করে অর্থের বিনিময়ে বর্তমান নেতৃত্বকে নিয়ে আসেন।

আ.লীগ কার্যালয়ে মাদকের বোতল

২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্প্রতি ফেনসিডিলের বেশ কয়েকটি খালি বোতল পাওয়া যায়। কার্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন। তবে মাদকের বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি–সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে আগে থেকেই অভিযোগ ছিল।

সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলিস্তান পার্টি অফিসে কিছু লোক মদের বোতল রেখে ছবি তুলে নেত্রীকে পাঠিয়েছে। এগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এটি ষড়যন্ত্র। মাদক যদি নিতেই হয়, অনেক জায়গা আছে, পার্টি অফিসে কেন?’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আজ (শনিবার) সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সভা আছে। সেখানে ছাত্রলীগের কমিটির বিষয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার।