খালেদাকে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা বলছেন, তাঁদের পাগলা গারদে পাঠানো হোক: বিচারপতি শামসুদ্দিন

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে অপসারণের দাবিতে ওই এলাকায় আজ শুক্রবার মানববন্ধন হয়
ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বলার মধ্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। যাঁরা এ ধরনের কথা বলছেন, তাঁদের পাগলা গারদে পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

আজ শুক্রবার ঢাকায় এক মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ‘রাজাকারপুত্র’ আখ্যায়িত করেছেন বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবিষ্কার করেছেন, খালেদা জিয়া নাকি মুক্তিযোদ্ধা। এই ধরনের উন্মাদ, এই ধরনের পাগল যাঁরা, এ রকম পাগলামি কথা বলে জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন যাঁরা, তাঁদের সরাসরি পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। তা না হলে জাতি বিভ্রান্ত হবে।’

সম্প্রতি কয়েকটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যে খালেদা জিয়াকে দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানকে শিশু মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

জবাবে গতকাল বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁওয়ে এক সভায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে যখন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, তখন খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের (সেনানিবাস) বাসায় তাঁর দুই শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে ছিলেন। ওই সময় অষ্টম বেঙ্গলের সেনারা চলে এসে বলেছিলেন, “পাকিস্তানি সেনারা বলছে অস্ত্র সমর্পণ করতে। আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব কি না?” তিনি সেদিন বলেছিলেন, “তোমাদের অধিনায়ক মেজর জিয়ার নির্দেশ ছাড়া তোমরা কোনো অস্ত্র সমর্পণ করবে না।” সেই দিন থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।’

তবে বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্য নাকচ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা করা মানে রাও ফরমান আলী ও নিয়াজীকে মুক্তিযোদ্ধা করা। এই হাস্যকর, এই পাগলামি যাঁরা করছেন, তাঁদের তো এই সমাজে জায়গা থাকতে পারে না।’

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে অপসারণের দাবিতে ওই এলাকায় আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য দেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিদ্রোহের অভিযোগে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের স্বজনেরা এই মানববন্ধনের আয়োজন করেন।

মানববন্ধনে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আজ আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি তাঁদের সমর্থনে, যাঁরা তাঁদের স্বামী, পিতা, ভাইকে হারিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালের সেই দিনগুলোতে খুনি জিয়াউর রহমান শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে বিচারের প্রহসনের নামে হত্যা করেছিলেন। জাপানি এয়ারলাইনসের বিমান হাইজ্যাক হওয়ার পর খুনি জিয়া যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে খুন করেছিলেন, বিচারের নাটক সাজিয়েছিলেন, সেটি আইনের কোনো অর্থেই বিচার ছিল না।’

সর্বোচ্চ আদালতের সাবেক এই বিচারপতি বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়ায় যা যা মানতে হয়, তার কোনোটিই সেখানে মানা হয়নি। তাঁদের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি আত্মপক্ষ সমর্থনের। এমনকি আগে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রায় দেওয়া হয়েছে পরে। আরও দুঃখজনক হলো যাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর না করে সেটি হয় নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই হলো জিয়ার কাজ, যিনি কিনা ইতিহাসের সেই চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং, নাদির শাহর চেয়েও বেশি নির্মম ব্যক্তি ছিলেন। জিয়া কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর যাঁরা পথে ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন, তাঁদের খুন করেছিলেন। সেই কারণে জিয়া কিন্তু একজন ‘যুদ্ধাপরাধীও বটে’।

জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের দাবি জানিয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সবার দাবি, জিয়ার মরণোত্তর বিচারের জন্য আইন করা হোক। আমাদের সংবিধানে এ ধরনের আইন করতে কোনো বাধা নেই। আইন করে শুধু জিয়া নন, অন্য যাঁরা এই ধরনের বেআইনি হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন তাঁদের সবারই বিচার করা হোক। এর মধ্যে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন। কালবিলম্ব না করে একটি তদন্ত কমিশন গঠন এবং মরণোত্তর বিচারের জন্য আইন করা হোক।’

জিয়াকে ‘খুনি ও যুদ্ধাপরাধী’ আখ্যায়িত করে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘একজন খুনি, একজন যুদ্ধাপরাধীর প্রতীকী কবর এই সংসদের কাছে থাকতে পারে না। আমরা জানি, এখানে খুনি জিয়ার দেহ নেই। প্রতীকী একটি কবর সাজিয়েছেন তাঁরা। এটি অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে এবং অবিলম্বে এটি করতে হবে।’

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে অপসারণের দাবিতে ওই এলাকায় আজ শুক্রবার মানববন্ধন হয়
ছবি: প্রথম আলো

মানববন্ধনে সার্জেন্ট আবুল বাশার খানের মেয়ে বিলকিস চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আজও জানি না আমার বাবার কবর কোথায়। খুনি জিয়া অন্যায়ভাবে আমার বাবাকে হত্যা করেছে। আমার বাবার কবর কোথায় আমরা জানতে চাই। আমার বয়স তখন চার বছর ছিল। সারা জীবন আমি আমার মাকে কাঁদতে দেখেছি। এখনো আমার মা কেঁদে চলেছেন। অথচ এই খুনের বিচার হয়নি।’

সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন–অর–রশীদ বলেন, জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিদ্রোহের নামে কিছু সৈনিক ও অফিসারকে গ্রেপ্তার করে হত্যা করা হয়। তাঁদের বিচার না করেই হত্যা করা হয়েছে। যে কয়েকটি বিচার হয়েছিল, সেটা ছিল প্রহসন। এমনও হয়েছে, বিচারে রায় দিয়েছে, ফাঁসি হোক। অথচ ফাঁসির রায় আগেই কার্যকর হয়েছে। আজ এখানে যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা সবাই স্বজন হারিয়েছেন। স্বজনদের হত্যার বিচার চাইতে এখানে এসেছেন। অবিলম্বে এই গণহত্যার বিচার হওয়া জরুরি।

করপোরাল মোবারক আলীর মেয়ে মমতাজ বেগম বলেন, ‌তাঁর বাবাকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। এরপর তাঁর বেড়ে ওঠা যে কত কষ্টের, সেটা বলার মতো ভাষা নেই। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল। তখন তিনি পেট ভরে ভাতও খেতে পারেননি।