২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ক্যাম্পাসে ‘ন্যূনতম সহাবস্থান’ এখন হুমকির মুখে

ডাকসু আবার অকার্যকর হয়ে যাওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ কাজ না করায় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সহাবস্থান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার পথে ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। গত ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে
ফাইল ছবি

তিন বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে ঢোকার ‘সুযোগ’ দেয় ছাত্রলীগ। আবাসিক হলে থাকার সুযোগ না পেলেও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে নিয়মিত কর্মসূচি পালনের সুযোগ পাচ্ছিলেন।

এর মধ্যে অবশ্য কয়েকবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হলেও ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদলকে ‘বিতাড়িত’ করা হয়নি। গত ২২ মে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ দুই দফা ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। ক্যাম্পাসেও ছাত্রদলকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ।

এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে ‘ন্যূনতম সহাবস্থান’ বলতে যা এত দিন ছিল, সেটিও বিলুপ্ত হতে চলেছে। ছাত্রদল ঠেকাতে ২৩ মে থেকে ক্যাম্পাস ‘পাহারা’ দিচ্ছে ছাত্রলীগ। প্রথম কয়েক দিন লাঠিসোঁটা ও স্টাম্প হাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পুরো ক্যাম্পাসে মহড়া দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার মহড়া না দিলেও মধুর ক্যানটিনে ছাত্রলীগের বড় জমায়েত ছিল। ছাত্রদলের ওপর দুই দফা হামলা এবং তাদের ঠেকানো নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, ডাকসু আবার অকার্যকর হয়ে যাওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ কাজ না করায় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সহাবস্থান নষ্ট হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর ফল হচ্ছে পাল্টাপাল্টি হামলা, মারামারি এবং ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া।

‘দেখা যাক। যখন যেটি প্রয়োজন হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় সেটি করে থাকে। অযাচিতভাবে ক্যাম্পাসে কোনো আতঙ্ক তৈরি করার কোনো কারণ নেই। যথাসময়ে যথাযথভাবে কার্য সম্পাদিত হবে। ক্যাম্পাসে একাডেমিক কার্যক্রম যথাযথভাবে চলছে। আমরা চাই, এই অবস্থার যাতে কোনোভাবেই ব্যাঘাত না ঘটে।’
মো. আখতারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলোর সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক ছাত্ররাজনীতি প্রতিরোধ এবং শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্য নিয়ে আশির দশকে পরিবেশ পরিষদের যাত্রা শুরু হয়। উপাচার্য এর প্রধান আর ক্রিয়াশীল ১৩টি ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতারা পরিষদের সদস্য।

গত এক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের তিনটি সভা হয়েছিল। তবে ওই তিন সভাই ছিল ‘রুটিন ওয়ার্ক’। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যা বা সংকটের বিষয়ে আলোচনার জন্য পরিবেশ পরিষদের কোনো সভা ডাকেননি উপাচার্য। ফলে যে লক্ষ্য নিয়ে পরিবেশ পরিষদ গঠিত হয়েছিল, এখন এর কার্যকারিতা আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন।

পরিবেশ পরিষদের সর্বশেষ সভা হয় চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মূলত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন সামনে রেখে সভাটি ডাকা হয়েছিল। সেখানে আবাসিক হলগুলোতে কয়েক বছর ধরে চলে আসা ‘গেস্টরুম নির্যাতনের’ সংস্কৃতি বন্ধের দাবি তোলে ছাত্রদলসহ বেশির ভাগ সংগঠন। এর আগে গত বছরের ২৫ নভেম্বর পরিষদের আরেকটি সভা হয়। ওই সভাও ডাকা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি ও মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন সামনে রেখে। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকা হয় করোনার সংক্রমণে বন্ধ থাকা আবাসিক হল খোলার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।

পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকা ও ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার কোনো চিন্তা আছে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেখা যাক। যখন যেটি প্রয়োজন হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় সেটি করে থাকে। অযাচিতভাবে ক্যাম্পাসে কোনো আতঙ্ক তৈরি করার কোনো কারণ নেই। যথাসময়ে যথাযথভাবে কার্য সম্পাদিত হবে। ক্যাম্পাসে একাডেমিক কার্যক্রম যথাযথভাবে চলছে। আমরা চাই, এই অবস্থার যাতে কোনোভাবেই ব্যাঘাত না ঘটে।’

পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। সন্ত্রাসী কায়দায় রাজনীতি করা ছাত্রদলের বিরুদ্ধে পরিবেশ পরিষদের মাধ্যমে প্রশাসনের একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক

উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ‘বিতাড়িত’ হয়েছিল ছাত্রদল। এর ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে। ডাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে ভূমিকা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মিথস্ক্রিয়ার প্ল্যাটফর্ম পরিবেশ পরিষদের।

ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি পরিবেশ পরিষদের সভায় অংশ নিতে দীর্ঘদিন পর বাধাহীনভাবে ক্যাম্পাসে আসেন ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা। সেদিন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সেদিন ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে সেলফি তোলেন। ৭ ফেব্রুয়ারি বড় মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয় ছাত্রদল। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েক মাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নির্বিঘ্ন চলাচলের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।

পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকা নিয়ে আপত্তি না থাকলেও সেখানে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ‘সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত’ দেখতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। সন্ত্রাসী কায়দায় রাজনীতি করা ছাত্রদলের বিরুদ্ধে পরিবেশ পরিষদের মাধ্যমে প্রশাসনের একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সামরিক স্বৈরাচারের লেজুড়বৃত্তি করা জাতীয় ছাত্রসমাজ যদি ক্যাম্পাসে পরিবেশ পরিষদের মাধ্যমে নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে ছাত্রদলের ব্যাপারেও পরিবেশ পরিষদের সিদ্ধান্ত একই হওয়া উচিত। আর ডাকসু নির্বাচনের ধারাবাহিকতা রক্ষার ব্যাপারে ছাত্রলীগ সব সময় সোচ্চার।

অন্যদিকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দলকানা না হয়ে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকের ভূমিকা যদি পালন করে, তাহলে পরিবেশ পরিষদের সভার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই ছাত্রদল ক্যাম্পাসে সীমিত রাজনৈতিক অধিকার পেয়েছিল। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ গণতন্ত্রের চর্চা চায় কি না, এটি একটি চিন্তার বিষয়। পরিবেশ পরিষদে কী হবে, তা ছাত্রলীগ আগেই নির্ধারণ করে দিতে পারে না। সেখানে ছাত্রসংগঠনগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই সিদ্ধান্ত নেবে।

এদিকে ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের দুই অংশ, ছাত্র ফেডারেশনের দুই অংশসহ আটটি ছাত্রসংগঠন গত ২৬ মে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ অকার্যকর। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসমুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য পরিবেশ পরিষদের কাজ করার কথা থাকলেও প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় পরিষদটির অস্তিত্বের কথা শিক্ষার্থীরা ভুলতে বসেছেন।’

এদিকে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকা ও ডাকসু নির্বাচন দাবি করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদ। গতকাল উপাচার্যকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ডাকসুর নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে সব দল ও মতের সহাবস্থান নিশ্চিতের একটা বাতাস বইছিল।

ডাকসুর এই অর্জনকে ম্লান করে দিতে এবং ডাকসু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে একটি মহল সব সময় সচেষ্ট ভূমিকা পালন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগের এমন উগ্র আচরণ‍। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের হামলা এবং পরে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়ায় শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত।’