কেন্দ্রীয় নেতাদের নীরবতা নিয়ে দলেই প্রশ্ন

কোম্পানীগঞ্জে আড়াই মাস ধরে চলছে উত্তেজনা-সংঘাত। নিহত হয়েছেন দুজন। তবু মুখ খুলছে না কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আড়াই মাস ধরে চলা রাজনৈতিক বিতর্ক, উত্তেজনা, সংঘাতের পথ ধরে একজন সাংবাদিকসহ দুজনের প্রাণহানির পরও দলের নির্বিকার ভূমিকাকে অস্বাভাবিক বলছেন খোদ আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের কয়েকজন এ ঘটনাকে দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতাও বলছেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা মনে করেন, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তৃণমূলের এই সংঘাত সহজেই সামাল দেওয়া যেত। কিন্তু দলের কোনো পর্যায় থেকেই কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, এই প্রশ্ন যেমন সাধারণ মানুষের, তেমনি এই সমস্যার সূত্রপাত যিনি করেছেন, সেই আবদুল কাদের মির্জাও প্রশ্ন তুলেছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কেন কথা বলছেন না।

সপ্তাহ তিনেক আগেও একবার প্রথম আলো এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেছিল। তখনো এ নিয়ে কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। সবাই বলেছেন, এটি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বিষয়। গতকাল বুধবার আবার এই প্রতিবেদক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর তিনজন সদস্য, সম্পাদকমণ্ডলীর পাঁচজন সদস্য এবং মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা বললেন, ঘটনাটি ঘটেছে দলের সাধারণ সম্পাদকের জেলায়, তাঁর নিজ নির্বাচনী আসনে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর পরিবার। তাই তাঁরা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে রাজি নন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এই নেতারা বলেন, এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল চরিত্র বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। তিনি ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। এ ছাড়া তাঁর আর বড় কোনো পরিচয় নেই। নোয়াখালীর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা বা সাংসদদের মধ্যেও এমন কেউ নেই, যিনি জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন। এমন একটা সাংগঠনিক স্তরের সংঘাত টানা আড়াই মাস জাতীয় রাজনীতির খবর হচ্ছে। এটা সামাল না দিতে পারা দলীয় ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ব্যর্থতার দায়ভার অনেকটাই ওবায়দুল কাদেরের ওপর বর্তায় বলে দলের ভেতরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা আছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা কেন আরও কঠোর হচ্ছেন না, তা-ও ভেবে পাচ্ছেন না এই নেতারা। তবে তাঁরা বলেছেন, অতীতে এর চেয়ে বড় এবং জটিল বিষয় সহজে সামাল দেওয়া হয়েছে।

অতীতে তৃণমূলে এমন সংঘাতপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হলে কী করা হয়েছে, এর একটা ধারণাও দিয়েছেন এই নেতারা। তাঁরা বলছেন, কোনো জেলা বা উপজেলায় দলীয় কোন্দলে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ও অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা জেলায় গিয়ে বিবদমান পক্ষগুলোকে নিয়ে বসে মীমাংসার চেষ্টা করে থাকেন। এতে কাজ না হলে স্থানীয় নেতাদের ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করে বোঝান অথবা সতর্ক করে কড়া নির্দেশনা দিয়ে ফেরত পাঠান। এতেও কাজ না হলে কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এর বাইরে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে বা ঘটনাটি জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও তৎপর হয়। চলে মামলা, গ্রেপ্তার। কিন্তু নোয়াখালীর ক্ষেত্রে এর কোনোটাই করা হয়নি। মানে সাংগঠনিক কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

আবদুল কাদের মির্জা প্রায় আড়াই মাস আগে প্রথমে পরিবার ও স্থানীয় নেতাদের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। এটাকে দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল মনে করেছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম উল্লেখ করে চাঁদাবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও অপরাজনীতির অভিযোগ তোলেন তিনি। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভাই ওবায়দুল কাদেরের নাম বলতেও ছাড়েননি তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন মন্ত্রী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল কাদের মির্জার সব অভিযোগ সত্য হলে দলের পক্ষ থেকে তা শোধরানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আর অভিযোগ মিথ্যা হলে তা-ও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়ে খোলাসা করা যায়। তিনি বলেন, কাদের মির্জা ও সংঘাতে জড়িত অন্য নেতাদের বিরুদ্ধে এত দিনে দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু চুপ থাকার ফল কী হলো? দুজন মানুষের প্রাণ গেল। এর দায় এখন কে নেবে? তাঁর ব্যাখ্যা, এ থেকে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের কাছে এমন বার্তাই গেছে যে নোয়াখালীর ঘটনায় দলের ভেতর থেকেই ইন্ধন আছে। নতুবা দল কোনো কিছু আড়াল করতে চাইছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এলাকায়। তাঁকেই সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য তাঁরা বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছেন না।

অবশ্য গতকাল নিজের বাসায় বসে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কোম্পানীগঞ্জে বিশৃঙ্খলায় জড়িতদের পরিচয় না দেখে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাবের মহাপরিচালক, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। দুজনের প্রাণহানির বিষয়ে তিনি বলেন, এটা নিন্দনীয় ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ঘটনার বিষয়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে কেন্দ্রীয়ভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ৩১ ডিসেম্বর আবদুল কাদের মির্জা এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীর অনেক সাংসদ পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না। বসুরহাট পৌরসভার নির্বাচন ছিল ১৬ জানুয়ারি। কাদের মির্জার নানা উত্তেজনাকর বক্তব্য চলতে থাকে পৌর নির্বাচনের পরও। এর জের ধরে ১৯ ফেব্রুয়ারি কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ওরফে বাদলের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। পরে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

পরদিন সন্ধ্যায় দলের সব কার্যক্রম থেকে কাদের মির্জাকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে চিঠি পাঠানোর কথা গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ। বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার দুই ঘণ্টা পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী ফোন করে সাংবাদিকদের জানান, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী সদর আসনের সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী জানান, সুপারিশ প্রত্যাহার হয়নি। এর তিন সপ্তাহ পর গত পরশু পুনরায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত, গোলাগুলির ঘটনায় আলাউদ্দিন নামের আরেকজন মারা যান। এই দুই ঘটনার মাঝখানেও বিভিন্ন সময় দলের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

এই পুরো সময়ে স্থানীয় সাংসদ ও দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে কাদের মির্জা প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের জাতীয় নেতারা কেন চুপ করে বসে আছেন, আমি জানি না।’ এর আড়াই ঘণ্টা পর ওবায়দুল কাদের তাঁর ফেসবুকে কিছু ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দেন, ‘আমার নীরবতার পেছনের কারণ কেউ জানে না।’

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে জেলা কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারে। তবে তা অনুমোদন করার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির। অথবা কেন্দ্রীয় কমিটি চাইলে যে কাউকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিতে পারে। নোয়াখালীর ক্ষেত্রে এর কোনোটাই হয়নি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশেই আওয়ামী লীগের ভেতর দ্বন্দ্ব আছে। এর পেছনে মোটাদাগে কতগুলো কারণ আছে। এগুলো হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া, দলীয় পদ-পদবি পাওয়ার চেষ্টা, উন্নয়নকাজের ভাগ-বাঁটোয়ারা ইত্যাদি। নোয়াখালীতে কোন কারণটি কাজ করছে, এ বিষয়ে স্পষ্ট হতে পারছেন না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। এই পরিস্থিতিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও ভেতরে-ভেতরে নিজেদের পছন্দমতো নোয়াখালীর বিবদমান পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আর এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ছে। ফলে নোয়াখালীর ঘটনা এখন আর স্থানীয় দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ নেই। এখন একমাত্র দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করছেন সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য।