দলের নির্দেশনা না থাকলেও আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীদের কেউ কেউ মাঠে ছিলেন। তবে সেটা বিচ্ছিন্নভাবে এবং সংখ্যায় গুটি কয়েক। হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করে নোয়াখালী জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল হকসহ কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
নোয়াখালীর চৌমুহনীতে মন্দির-মণ্ডপে আক্রমণ ও ভাঙচুরের সময় পুলিশ প্রশাসনের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও পাশে পাননি হিন্দুরা। হামলা হলে ঠেকানোর মতো কোনো দলীয় প্রস্তুতিও ছিল না দলটির। দলটির নেতারাই বলছেন, চৌমুহনীতে পৌর এলাকার পূজামণ্ডপে হামলা হতে পারে, এমন চিন্তাও তাঁরা করেননি। আর এ কারণে বেগমগঞ্জ উপজেলার ইউনিয়নগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা মাঠে থাকলেও, চৌমুহনী পৌর এলাকায় দলটির স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের ছিল গা ছাড়া ভাব।
ঘটনার দিন চৌমুহনীতে আওয়ামী লীগের এ নিষ্ক্রিয়তা ‘সুবিধা’ করে দেয় দুর্বৃত্তদের। শহরের একে একে ১২টি মন্দির ও মণ্ডপে ভাঙচুর ও লুটপাট করে তারা।
১৩ অক্টোবর বুধবার দুর্গাপূজার মহা অষ্টমীর দিন নোয়াখালীর পাশের জেলা কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার জেরে একই দিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়আনিতে একটি মণ্ডপে হামলা হয়। শুক্রবার ছিল বিসর্জনের দিন। পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রতিবাদে ওই দিন জুমার নামাজের পর বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হতে পারে, এটা জানাই ছিল। বিক্ষোভের বিষয়টি জানিয়ে নোয়াখালীর এখলাসপুরে মাইকিং করা হয়েছে, বাংলাবাজারে লিফলেট বিতরণও করা হয়েছিল। বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় প্রশাসন আগের দিন বৃহস্পতিবার বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের সঙ্গে সভা করে কিছু নির্দেশনাও দিয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়কে দুপুর ১২টার আগেই দেবী দুর্গার বিসর্জন কাজ শেষ করতে বলেছিল।
বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম জাফর উল্যাহ নোয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। আর সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ বেগমগঞ্জ আসনের (নোয়াখালী–৩) সাংসদ। কিন্তু তাঁরা চৌমুহনীতে বিভিন্ন মসজিদ বা মণ্ডপে দলীয় নেতা–কর্মীদের অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি। কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, তাঁরা মনে করেছিলেন গ্রাম এলাকায় ঝামেলা হতে পারে। সে কারণে ইউনিয়নগুলোতে নেতা–কর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের নেতারা যেটা চিন্তা করেননি, হয়েছে সেটাই। জুমার নামাজের পর হাজারের বেশি মানুষ চৌমুহনীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সেখান থেকে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা ১২টি মন্দির ও মণ্ডপে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। চৌমুহনীর রামচন্দ্র দেবের সমাধিক্ষেত্রে ভুক্তভোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন পান্না লাল বলছিলেন, ‘সাহায্যের জন্য পুলিশের ওসি, এসপি, এমপিকে ফোন করা হলেও কেউ ফোন ধরেননি।’
নোয়াখালী জেলার প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র এই বেগমগঞ্জের চৌমুহনী। এই পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে মন্দির ও অস্থায়ী মণ্ডপ মিলিয়ে ছয়টি জায়গায় পূজা হয়েছিল। যেগুলো আক্রমণের শিকার হয়। এই ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কমিশনার এনায়েতুল্লাহ চৌধুরী আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও দলের রাজনীতিতে সক্রিয় নন। দলের কোনো পদেও তিনি নেই। এনায়েতুল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জুমার নামাজের পর চণ্ডিকা পূজামণ্ডপে হামলার খবর পেয়ে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে সেখানে ছুটে যান। আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারা তাঁর মোটরসাইকেলটিও ভাঙচুর করে। তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে যদি ৫০–১০০ জন মানুষ থাকত, তাহলে হয়তো তিনি প্রতিহত করতে পারতেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, চৌমুহনীতে আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বেগমগঞ্জের (নোয়াখালী–৩) সাংসদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদ। আর অন্য পক্ষে আছেন সাবেক পৌর মেয়র আক্তার হোসেন। তিনি পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি।
টেলিফোনে আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছেলের চিকিৎসার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
চৌমুহনীর মেয়র খালেদ সাইফুল্লাহ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে জেতেন। দলীয় রাজনীতিতে না থাকলেও তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি স্থানীয় সাংসদ মামুনুর রশীদের বড় ভাই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি ছিল পরিকল্পিত আক্রমণ। কিন্তু আগে তাঁরা বুঝতে পারেননি। তিনি মিছিলের খবর পেয়ে ছুটে যান। বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ শুরু হলে পুলিশের একজন সদস্য তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে আনেন।
দলের নির্দেশনা না থাকলেও আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা–কর্মীদের কেউ কেউ মাঠে ছিলেন। তবে সেটা বিচ্ছিন্নভাবে এবং সংখ্যায় গুটি কয়েক। হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করে নোয়াখালী জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল হকসহ কয়েকজন আহতও হয়েছেন।
স্থানীয় সাংসদ মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা (আক্রমণকারীরা) পরিকল্পনা করে করছে, আমাদের পরিকল্পনার অভাব ছিল।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা একেকজন একেক মসজিদে নামাজ পড়েছেন। তবে তাঁরা ধারণা করেছিলেন, কোনো গন্ডগোল হবে না। কিছু হলেও সেটা হবে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে। এ কারণে ছয়টি ইউনিয়নের ১৩টি মণ্ডপে তাদের নেতা–কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। শহরে পুলিশের জনবলও বেশি। এসব কারণে নির্দেশনা সেভাবে দেওয়া হয়নি। সাংসদ মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি না গেলেও তাঁর ছেলে তাঁর (সাংসদের) গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। হামলাকারীরা গাড়িটি ভাঙচুর করে।
দলীয় কোন্দলের সুযোগে এ ঘটনা ঘটার সুযোগ হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মামুনুর রশীদ বলেন, তিনি তা মনে করেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফোন না ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় এই সাংসদ বলেন, ঘটনার পরপর তিনি দুটি ফোনে দলের কেন্দ্রীয় নেতা, পুলিশের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যস্ত ছিলেন। যে কারণে অনেকের ফোন ধরতে পারেননি।