আউয়ালের শক্তির মহড়ায় আতঙ্ক
দুর্নীতির মামলায় বিতর্কিত সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়ালের জামিন এবং বিচারক বদলির ঘটনায় পিরোজপুরের রাজনৈতিক অঙ্গন, স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে আতঙ্কও।
অন্যদিকে আউয়ালের সমর্থকেরা এই ‘জামিন-কাণ্ড’কে নিজেদের শক্তির মহড়া হিসেবে দেখছেন।
পিরোজপুরে কর্মরত একাধিক সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনা, বিশেষ করে বিচারককে তাৎক্ষণিক বদলির ঘটনায় বিচারাঙ্গনের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি বিভাগের কর্মকর্তারাও উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন। কারণ, এরপর অন্য যে কারোর ক্ষেত্রে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তাঁদের এ শঙ্কার বিষয়টা কিছুটা উঠে আসে গত বৃহস্পতিবার পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নানের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কয়েকজনের বক্তৃতায়।
আউয়ালের জামিন–কাণ্ডের ঘটনায় এই বিচারককেই তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছিল। তাঁর বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সরকারি বিভিন্ন বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে অনেকে হয়তো শঙ্কিত। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলার সুযোগ তাঁদের নেই। বিদায় অনুষ্ঠানে সাধারণত কিছুটা আবেগতাড়িত বক্তব্য দেওয়া হয়। আর বিদায়টা একটু অস্বাভাবিক হওয়ায় কারও কারও বক্তব্যে আবেগটা বেশি ছিল।
৩ মার্চ সকালে পিরোজপুরের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল তিনটি মামলায় এবং তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলায় পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। বিচারক মো. আবদুল মান্নান জামিন নামঞ্জুর করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে আউয়ালের কর্মী–সমর্থকেরা বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করেন। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন জ্বালিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। পরে বিকেলে জেলা ও দায়রা জজ মো. আবদুল মান্নান বদলির চিঠি পান। এরপর তিনি যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। বিকেল পৌনে চারটার দিকে আউয়াল ও লায়লার জামিন মঞ্জুর করেন ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিন। এই জামিন ও বদলির ঘটনায় সাধারণ মানুষ এবং আওয়ামী লীগের একটি অংশের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তাঁদের অনেকে মনে করছেন, এতে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে। শহরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বলাবলি হচ্ছে, আগে প্রবাদ ছিল ‘হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না’। কিন্তু পিরোজপুরে হাকিম ও হুকুম দুটাই নড়েছে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পিরোজপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সরদার ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দৃষ্টান্তটি ভালো হয়নি। এর ফলে বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে। মানুষ মনে করছে, অপকর্ম করেও শক্তির জোরে পার পাওয়া যায়।
>আউয়ালের জামিন ও বিচারক বদলিতে রাজনৈতিক অঙ্গন, প্রশাসনসহ নানা মহলে ক্ষোভ
বিচারককে তাৎক্ষণিক বদলির ঘটনায় বিচারাঙ্গনের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি বিভাগের কর্মকর্তারাও উদ্বেগে
আউয়ালকে কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর সড়ক অবরোধ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও সে ঘটনায় কোনো মামলা বা জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করেনি পুলিশ। এ বিষয়ে পিরোজপুরের পুলিশ সুপার হায়াতুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক অবরোধ করা হলেও পুলিশ দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক করে। একটি ব্যক্তিগত কার্যালয় ভাঙচুর হয়েছে। কেউ কোনো অভিযোগ না দেওয়ায় মামলা হয়নি; জিডিও হয়নি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, আউয়ালের সমর্থকেরা আগে থেকেই শক্তি প্রদর্শনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কারণ, তাঁদের আশঙ্কা ছিল জামিন নামঞ্জুর করে আউয়াল দম্পতিকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আড়ালে মূল ভূমিকায় ছিলেন আউয়ালের ভাই পিরোজপুর সদরের পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান (মালেক)। তাঁর কর্মী–সমর্থকেরাই বিভিন্ন জায়গায় মাঠে নামেন। আউয়ালের পরিবারের মূল উদ্দেশ্য ছিল জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন সামনে রেখে নিজেদের পারিবারিক প্রভাবের জানান দেওয়া এবং নিজ দলীয় বিরোধী পক্ষকে একটি বার্তা দেওয়া। আউয়ালের সমর্থকেরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজ দলীয় প্রতিপক্ষ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের অনুসারীদের কোণঠাসা করার পাশাপাশি আউয়ালের নয়া উত্থানের একটি বার্তা দেওয়া গেছে।
অবশ্য এ কে এম এ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার সময় তিনি পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। এলাকার সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাঁর দাবি, যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় এবং রাজনীতিতে যাদের পাঁচজন লোক জড়ো করার মতো সামর্থ্য নেই, তাদের মধ্যেই উদ্বেগ আছে। আর কেউ উদ্বিগ্ন নন।
নবম ও দশম সংসদে পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন এ কে এম এ আউয়াল। দুই মেয়াদে সাংসদ থাকাকালে আউয়াল এলাকার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, গণপূর্ত, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ আছে। আউয়ালের স্ত্রী লায়লা পারভীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বুশরা এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স সুভাস এন্টারপ্রাইজ প্রভাব খাটিয়ে কাজ নিতেন। আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও বের হয়। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁর ভাই হাবিবুর রহমানই প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আউয়াল টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। অবশ্য আউয়াল বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না।
তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর আউয়ালের প্রভাব–দাপট অনেকটা কমে যায়। তাঁর স্থলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শ ম রেজাউল করিম। স্থানীয় রাজনীতিতে মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, টানা ১০ বছর আউয়াল পরিবারের প্রভাব, চাঁদাবাজি, নানা অপকর্মে মানুষ ভীত ছিল। গত এক বছরে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। হঠাৎ উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিতে আবারও মানুষের মনে ভীতি কাজ করছে। রাজনৈতিক কর্মীরাও শঙ্কার মধ্যে আছেন, যেকোনো সময় তাঁরা আক্রমণের শিকার হতে পারেন।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, দুদকের মামলায় আউয়াল দম্পতির জামিন ও তাৎক্ষণিকভাবে বিচারকের বদলির ঘটনায় স্থানীয় রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাকিম হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, জামিন হওয়ায় আউয়ালের প্রভাব বেড়েছে। অনেকে তাঁকে ‘পাওয়ারফুল পারসন’ মনে করছেন। আউয়াল আবার আসছেন কি না, এ নিয়ে অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত।
আগামী পর্ব: পিরোজপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব