আ.লীগের মনোনয়ন দৌড়ে অনেক হোমরাচোমরা
>• ভোটের আগেই মাঠ গরমের কৌশল ছিল আ. লীগের
• নামকরা ব্যক্তিদের মনোনয়ন নিতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে
• অনেকের ভাবনা, আ. লীগের মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত
• সব মিলিয়ে এবার মনোনয়ন কেনার হিড়িক পড়ে গেছে
• মনোনয়ন ফরম কিনে সবচেয়ে আলোচিত মাশরাফি
• পিছিয়ে নেই এক-এগারোর আলোচিত মাসুদ উদ্দিনও
আলোচিত ব্যক্তি, তারকা, বড় ব্যবসায়ী—এই তিন শ্রেণির ব্যক্তিরা এবার ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন–দৌড়ে অংশ নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। চলচ্চিত্র তারকা, ক্রিকেটারসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা রীতিমতো মহড়া দিয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, ভোটের আগেই মাঠ গরম করার একটা কৌশল ছিল। এ জন্য নামকরা কিছু ব্যক্তি ও সাবেক ছাত্রনেতাকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আবার প্রার্থীদের অনেকের মধ্যে এমন ভাবনা যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত। এ কারণেও এবার মনোনয়ন কেনার হিড়িক পড়ে গেছে।
মনোনয়ন–দৌড়ে শরিক হয়েছেন এক–এগারোর আলোচিত ব্যক্তি লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীও। গুরুতর অপরাধ দমনসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি। এই কমিটির অধীনেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। এক–এগারোর পর তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর চাকরির মেয়াদও কয়েকবার বাড়ানো হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে ফেনী-৩ আসনে (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) নির্বাচন করতে চান তিনি। গত শনিবার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করে তা জমাও দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নির্বাচন করতে আগ্রহী। দলীয় ফরম কিনে তা জমা দিয়েছি। বাকিটা নেত্রীর সিদ্ধান্ত।’
গতকাল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। গতকাল দুপুরে মিছিলসহকারে ফরম সংগ্রহ করেন তিনি। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দোয়া নেন। মাশরাফি নড়াইল-২ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। এই আসনের বর্তমান সাংসদ ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির হাফিজুর রহমান।
জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও মাগুরা-১ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন বলে আলোচনা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সাকিব মত পাল্টান। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে খেলায় মনোযোগ দিতে বলেন। এই আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাইফুজ্জামান শেখর।
মনোনয়ন ফরম বিতরণের প্রথম দিনে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদাও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। বিএনপি ছাড়ার পর বিএনএফ হয়ে তিনি বিএনএ জোট গঠন করেন। তবে এই জোটের কোনো দলেরই নিবন্ধন নেই।
২০১০ সালে বিএনপির সমর্থন নিয়ে চট্টগ্রামের মেয়র হন মনজুর আলম। সর্বশেষ ২০১৬ সালেও বিএনপির সমর্থন নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ জ ম নাছিরের কাছে হেরে যান। এবার আওয়ামী লীগের হয়ে চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী, হালিশহর, খুলশী) আসনে প্রার্থী হতে চান তিনি।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অসুস্থ্ হয়ে বিদেশে চিকিৎসাধীন। কিশোরগঞ্জ-১ (সদর) আসন থেকে তাঁর পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর ভাই সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম, চাচাতো ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রাসেল আহমেদ, পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
তারকা প্রার্থী
তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ দীর্ঘদিন ধরেই। এবার তিনি টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে নির্বাচন করতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর এলাকার বর্তমান সাংসদ। আবারও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন তিনি। অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ সদর আসন থেকে সাংসদ হয়েছিলেন। এবার তিনি ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী হওয়ার জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। অভিনেতা শাকিল খানসহ আরও কিছু চলচ্চিত্র তারকা আওয়ামী লীগের দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছেন।
অভিনয়শিল্পী শমী কায়সার ও রোকেয়া প্রাচী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ফেনী-৩ আসনে (সোনাগাজী-দাগনভূঞা)। এখানে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও সাবেক আমলা আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিমও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এই আসনের বর্তমান সাংসদ রহিমউল্লাহ আওয়ামী লীগের নেতা। তবে স্বতন্ত্র হিসেবে গত নির্বাচনে জয়ী হন।
চিত্রনায়ক ফারুক গাজীপুর-৩ আসনে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের ফরম সংগ্রহ করেছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে তাঁর পদচারণ খুব একটা নেই। এ আসনে বর্তমান সাংসদ প্রবীণ নেতা রহমত আলী। ময়মনসিংহ-৩ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন তরুণ অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতি।
ব্যবসায়ী নেতা
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান ঢাকা-১ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে এই আসনে জাতীয় পার্টির সাংসদ আরেক ব্যবসায়ী গ্রুপ যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী সালমা ইসলাম। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সালাম মোর্শেদী সম্প্রতি খুলনা-৪ আসন থেকে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। গতকাল বিকেলে তিনি ওই আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক দুই সভাপতি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এর মধ্যে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। এই আসনের বর্তমান সাংসদ সোলায়মানুল হক জোয়ার্দার একাধিকবারের সাংসদ। আর ফরিদপুর-১ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন সাবেক সভাপতি দিলীপ রায় ও কাজী সিরাজুল ইসলাম। এখানে বর্তমান সাংসদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান।
নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সেলিমা আহমাদ কুমিল্লা-২ (হোমনা-তিতাস) আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। বর্তমানে এই আসনের সাংসদ মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির আমির হোসেন।
এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান পরিচালক আবু নাসের, আমিনুল হক শামীম, মাসুদ পারভেজ খান, তাবারুকুল তোসাদ্দেক খান টিটু ও রেজাউল করিম রেজনু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইছেন। মাসুদ পারভেজ খান ২০১৪ সালের নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কাছে হেরে যান। তাঁর বাবা আফজল খানের সঙ্গে বাহাউদ্দিনের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এবার মাসুদ পারভেজ ছাড়াও তাঁর বাবা আফজল খান ও বোন আঞ্জুম সুলতানাও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। আমিনুল হক ময়মনসিংহ সদর আসনের জন্য ফরম সংগ্রহ করলেও এই আসনের বর্তমান সাংসদ রওশন এরশাদ। এফবিসিসিআইএর সাবেক সহসভাপতি হেলাল উদ্দিনও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
এর বাইরে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে মোহাম্মদ নাসির, এস এম মান্নান, আসলাম সানি, মশি উজ জামান, মঈন উদ্দিন আহমেদ, নুরুল আলম চৌধুরী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট করার জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
অন্যান্য
দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আলোচনায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন হবিগঞ্জ-৪ আসন (মাধবপুর-চুনারুঘাট) থেকে। কুমিল্লা-৭ আসন থেকে ভোট করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন সংগ্রহ করে তা জমাও দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও তিনি দীর্ঘদিন ধরেই নিজ এলাকায় বিনা পয়সায় চিকিৎসা প্রদানসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। অবশ্য সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর থেকেই তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল।