রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসের ছাত্রদের সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কলেজে ছাত্রলীগের টেন্টে (তাঁবু) সময় দিতে হয়। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর নগরের মণিচত্বরে হওয়া জমায়েতেও থাকতে হয়।
ছাত্রলীগ ও মহানগর আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি থাকলে তাতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। কেউ যেতে না চাইলে করা হয় ‘নির্যাতন’। এ কারণে ঠিকমতো ক্লাস করা যায় না, পড়ালেখা ব্যাহত হয়। এই অভিযোগ ছাত্রাবাসের সাধারণ আবাসিক শিক্ষার্থীদের।
ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ দিতে আপত্তি করায় গত বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে গিয়ে অন্তত ৩০ ছাত্রকে মারধর করা হয়। এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাধারণ ছাত্ররা। এর আগে কর্মসূচিতে যাওয়া নিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রাবাসের সাত-আট শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়েছিল।
প্রশাসনিক তৎপরতার কারণে করোনার পর থেকে মুসলিম ছাত্রাবাসের পরিবেশ ভালো হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে ওঠেন। আর কোনো সিট ফাঁকা নেই।আনিসুজ্জামান, কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুসলিম ছাত্রাবাসের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক
তবে বুধবারের মারধরের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোনো সাধারণ ছাত্রকে আর দলীয় কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হবে না। ছাত্রলীগ নেতারা কথা দিয়েছেন, ছাত্রসংগঠনটি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আর কোনো অভিযোগ আসবে না।
ভুক্তভোগী ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার দুপুর ১২টায় হাইটেক পার্কে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানের জন্য তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল চারটায় কলেজ ক্যাম্পাসের একই কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর রাত আটটার দিকে ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে ঢুকে মারধর করে নগর ভবনে একই কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, নির্বাচন সামনে রেখে টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠান একই দিনে শহরের তিন জায়গায় আয়োজন করা হয়েছিল। রাতের বেলায় পড়াশোনা থাকায় তাঁরা যেতে আপত্তি করেছিলেন। এ জন্য তাঁদের মারধর করা হয়।
নির্যাতনের শিকার হন দুজন শিক্ষানবিশ গণমাধ্যমকর্মীও। তাঁরা হলেন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব ও শরিফুল ইসলাম। তাঁরা ক্যাম্পাস সাংবাদিক সংগঠন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির (আরসিআরইউ) সদস্য। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে মারধরের বিষয়টি জানানো হয়।
নাজমুস সাকিব বলেন, ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময় তাঁদের দলীয় কর্মসূচিতে জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান। বুধবার বিকেলেও ছাত্রলীগের একটা কর্মসূচিতে যেতে হয়। সেখান থেকে অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে যেতে চাইলেও ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আজম (কর্মসূচির আহ্বায়ক) তাঁকে ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে বলেন। আজমকে কোনোরকমে বুঝিয়ে তিনি হাসপাতালে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় ছাত্রাবাসে ফিরলে ছাত্রলীগের শাহরুখ, রাজু, আজম, হাসানসহ ৮ থেকে ১০ জন মিলে তাঁর কক্ষে ঢুকে তাঁকে মারধর করেন। এরপর নগর ভবনের কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় গতকাল দুপুর ১২টায় কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সভাকক্ষে ওই সভা শুরু হয়। সেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সভাপতি রাসিক দত্ত, অভিযুক্ত বহিরাগত শাহরুখ, ছাত্রলীগের কর্মী কাউসার আজম উপস্থিত ছিলেন। বহিরাগত শাহরুখ ও রিফাতের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে কোনো সাধারণ ছাত্রকে জোর করে আর দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া হবে না। তাঁরা কথা দিয়েছেন, ছাত্রলীগ নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অভিযোগ আসবে না।
পরে রাসিক দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, শাহরুখ ও রাফি দুজনেই বহিরাগত। তাঁরা সবার সামনে হাত-পা ধরে মাফ নিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, এখন তাঁরা শুধু তাঁদের কর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবেন। অন্যদের দাওয়াত দেবেন। কাউকে জোর করা হবে না।
সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন কলেজের অধ্যক্ষ মোহা. আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, আর এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। ঘটলে তারা (ছাত্রলীগ নেতারা) দায় বহন করবে।
ছাত্রলীগের ‘নির্যাতন’ নতুন নয়
রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে মোট সাতটি ব্লক রয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৫১২ জন ছাত্র থাকতে পারেন। শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৬ সাল থেকে ছাত্রলীগের অব্যাহত চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের কারণে ছাত্ররা ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। ওই বছরের ২৩ জুলাই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কোনো ছাত্র সেখানে ওঠার জন্য আবেদন করেননি। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর পুনরায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কোনো ছাত্র আবেদন করেননি।
সে সময় ছাত্রদের অভিযোগ ছিল, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক রাশেদুল করিম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাসিক দত্ত ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের ওপর এতই প্রভাব খাটান যে তাঁদের ভয়ে শিক্ষার্থীরা সব সময় তটস্থ থাকেন।
ওই বছরের ১৪ এপ্রিল রাতে এই ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে চার-পাঁচজন বহিরাগত হামলা চালিয়ে ল্যাপটপ, মুঠোফোন, টাকাপয়সা ও অন্যান্য জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর ছাত্রাবাস ছাড়তে শুরু করেন সাধারণ ছাত্ররা। ঘটনার তিন দিন পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে সময় ছাত্রাবাসের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছাত্র চলে যান।
এরপর ১৭ মার্চ রাতে একইভাবে ছাত্রাবাসের নিউ ব্লকের একটি কক্ষে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ব্যাপক ভাঙচুর করেন। তাঁরা একজন ছাত্রকে রড দিয়ে পেটান ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন। পরের দিন বেশ কিছু শিক্ষার্থী ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যান। ছাত্র না থাকায় নিউ ব্লকের ডাইনিং বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার দায় স্বীকার করে ঘটনার পরের দিন ছাত্রাবাসের তিনজন তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস উদ্দিন, আনিসুজ্জামান ও আব্দুর রাজ্জাক কলেজের অধ্যক্ষের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
পরের বছর (২০১৭) ছাত্রলীগের নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ঈদুল ফিতরের বন্ধের দুই দিন আগে কলেজ কর্তৃপক্ষ মুসলিম ছাত্রাবাস খালি করে দেয়। ঈদের ছুটির পর শুধু বৈধ ছাত্রদের ছাত্রাবাসে তোলার কথা ছিল, কিন্তু পরে আবার একইভাবে ছাত্রলীগের নেতারা ছাত্রাবাসের দখল নিয়ে নেন।
জানতে চাইলে কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মুসলিম ছাত্রাবাসের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনিক তৎপরতার কারণে করোনার পর থেকে মুসলিম ছাত্রাবাসের পরিবেশ ভালো হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে ওঠেন। আর কোনো সিট ফাঁকা নেই।