ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার হাটকৃষ্ণপুর বাজারটি শত বছরের পুরোনো ও সবচেয়ে বড়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় গতকাল শুক্রবার জনসমাগম ছিল বেশি। বেলা ১১টায় বাজারের একটি কাপড়ের দোকানের সামনে দেখা গেল মধ্যবয়সী আট থেকে দশজন আড্ডা দিচ্ছেন।
কাছে যেতে বোঝা গেল, তাঁদের আড্ডার আলোচনার বিষয় নির্বাচন। তাঁরা এই প্রতিবেদককে বলেন, আগের দুবার স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরী জিতলেও এবার লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। সেখানে আলহাজ মিয়া, জাহাঙ্গীর মাতাব্বর, রাজ্জাক মাতাব্বরসহ আড্ডায় থাকা অন্যরা বলেন, আগের দুবার তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছেন।
ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন ও সদরপুর—তিনটি উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর–৪ আসন। এখানে নৌকার প্রার্থী কাজী জাফর উল্যাহ। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরী নির্বাচন করছেন ঈগল প্রতীকে। তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। নৌকা ও ঈগলের প্রার্থী একই দলের হওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা দুই ভাগ হয়ে গেছেন; মানে জাফর–নিক্সনে বিভক্ত সেখানকার আওয়ামী লীগ।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এ আসনে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটেনি। তবে কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে নিক্সন চৌধুরীর বাগ্যুদ্ধে কখনো কখনো পরিবেশ উত্তপ্ত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রচারে একে অপরকে কথা দিয়ে ঘায়েলের চেষ্টা করছেন। দুই প্রভাবশালী প্রার্থীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করেছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৬১ হাজার ৮৪৫ জন। এ আসনে ২০১৪ সালে নিক্সন চৌধুরী ৯৮ হাজার ৩০০ ভোট এবং ২০১৮ সালে ১ লাখ ৪৪ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালে জাফর উল্যাহ ভোট পান ৭২ হাজার ২৪৮টি আর ২০১৮ সালে পান ৯৪ হাজার ২৩৪। এ নিয়ে তৃতীয়বার তাঁরা একে অন্যের মুখোমুখি হচ্ছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রধান দুই প্রার্থীর লড়াইয়ে জাফর উল্যাহর মূল শক্তি হবে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ভোটার। অন্যদিকে নিক্সন চৌধুরীর শক্তি তরুণদের ভোট।
সদরপুর উপজেলা বাজারে কথা হয় বিএনপির একজন নেতার সঙ্গে। দলটি ভোট বর্জন করে আন্দোলনে রয়েছে। পত্রিকায় নাম প্রকাশ করলে ব্যবসার ক্ষতি হবে। তাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির ওই নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে যাবেন না তিনি। নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, বয়স্করা এবার নৌকার পক্ষে কাজ করছেন। তবে তরুণদের ভোট ঈগলের পক্ষে।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলছেই
কাজী জাফর উল্যাহ ও নিক্সন চৌধুরী দুজনেই একই আদর্শের। দুই প্রভাবশালী প্রার্থীর মধ্যে কথার লড়াই চলছে অনেক দিন ধরেই। প্রতিদিন নির্বাচনী সভা–সমাবেশে তাঁরা একে অপরকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন; পাল্টাপাল্টি নানা অভিযোগ করছেন। জাফর উল্যাহ বক্তব্যে অভিযোগ করছেন, নিক্সন চৌধুরী খাসজমি দখল করছেন। চাঁদাবাজি করছেন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে মানুষের ভিটেমাটি ধ্বংস করছেন। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নিক্সন চৌধুরী নির্বাচনী হলফনামায় সঠিক তথ্য দেননি। নির্বাচনী হলফনামায় গত ১০ বছরে তাঁর সম্পত্তি ৫৪ গুণ বৃদ্ধি দেখিয়েছেন। কিন্তু আসলে তাঁর সম্পত্তি ৫৪০ গুণ বেড়েছে বলে অভিযোগ করেন জাফর উল্যাহ।
অন্যদিকে নিক্সন চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, জাফর উল্যাহ সার কারখানা থেকে কমিশন খেয়েছেন। টাকা পাচার করেছেন। তাঁর কমিশন খাওয়ার বিষয়টি পত্রিকায় এসেছে। ওনার নামে মানি লন্ডারিং মামলা হওয়া উচিত।
বিভক্ত আওয়ামী লীগ
নৌকা ও ঈগলের প্রার্থী একই দলের হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা বিভক্ত হয়ে গেছেন। নির্বাচনী এলাকা সদরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী শফিকুর রহমান পক্ষ নিয়েছেন নিক্সন চৌধুরীর। এ কমিটির সভাপতির মৃত্যুতে সম্প্রতি ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক ফকির আবদুস সাত্তার ও দুই যুগ্ম আহ্বায়ক আবু আলম রেজা ও রিপন সিকদার ভোটে কাজী জাফর উল্যাহর পক্ষে কাজ করছেন।
সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শহীদুল ইসলাম নিক্সনের সমর্থক। যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক গুঞ্জর মৃধা নৌকার সমর্থক। তবে এ আহ্বায়ক কমিটির অপর চার সদস্য নিক্সনের পক্ষে কাজ করছেন। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এ দুই নেতার পক্ষে কাজ করছে। তবে উপজেলা ছাত্রলীগ জাফর উল্যাহর পক্ষে কাজ করছে।
ফরিদপুর–৪ আসনে ভোটারদের অনেকে বলছেন, নির্বাচনে এবারও বড় একটি ফ্যাক্টর কাজ করবে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার সঙ্গে লাগোয়া ২২টি কেন্দ্রের ভোট। গত দুই নির্বাচনের মতো এ ২২টি কেন্দ্রে একচেটিয়া ভোট পেয়েছিলেন নিক্সন চৌধুরী। কারণ, নিক্সন চৌধুরীর বাড়ি মূলত শিবচরে।
মাঠে নেই অন্য প্রার্থীরা
নৌকা ও ঈগলের বাইরে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আরও পাঁচ প্রার্থী। তাঁরা হচ্ছেন জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির প্রিন্স চৌধুরী (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির আলমগীর কবির (একতারা), বাংলাদেশ কংগ্রেসের নাজমুন নাহার (ডাব) এবং তরীকত ফেডারেশনের মাকসুদ আহাম্মেদ মাওলা (ফুলের মালা)। স্থানীয় লোকজন বলছেন, নির্বাচনে প্রচার দেখা যাচ্ছে শুধু নৌকা ও ঈগলের। বাকি প্রার্থীদের প্রচার নেই। তবে কয়েকটি স্থানে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর পোস্টার চোখে পড়েছে।