বিশ্লেষণ: উজরা জেয়ার সফর
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে অবস্থান অটুট থাকবে, সম্পর্কও এগিয়ে যাবে
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, উজরা জেয়া ঢাকায় এসে নির্বাচন ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে যে বার্তা দিয়ে গেলেন, সেটিকে সরকার হয়তো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছে।
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতের স্বার্থে মে মাসে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র।
এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার ঢাকা সফর নিয়ে কৌতূহল ছিল। এই জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তার সফরে নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, তা দুই পক্ষের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।
উজরা জেয়ার এই সফরের উদ্দেশ্য কী ছিল, তা গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের স্বীকৃতি দিতে আমি এখানে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র এই সম্পর্ককে আরও নিবিড় করতে চায়।’
উজরা জেয়া গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে চার দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ওয়াশিংটনে ফিরে যান।
মাস দুয়েক ধরে বিশেষ করে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে নানা জল্পনা রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এমন পরিস্থিতিতে উজরা জেয়ার বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ওই সময় ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, সেটা নীতিগত। এখানে কোনো বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব কিংবা নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যুক্ততার কোনো আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের নেই। ফলে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান অটুট রেখেই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহী ওয়াশিংটন। পাশাপাশি বাংলাদেশের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের কারও পক্ষ নেওয়ার অভিপ্রায় নেই, সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে সরাসরি এই বার্তা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উজরা জেয়ার সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়টি ঠিক হয়।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব নিয়ে কাজ করেন, এমন একাধিক কূটনীতিকের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার কথা বলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে আগামী সেপ্টেম্বরে সংসদের যে অধিবেশন বসবে সেটাই হতে পারে চলতি একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশন। সেক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে ঢাকায় এটাই উচ্চপর্যায়ের শেষ সফর। ফলে ভিসা নীতি ঘোষণার পর উজরা জেয়াকে ঢাকায় পাঠিয়ে ওয়াশিংটন নিজেদের রাজনৈতিক বার্তাটা বাংলাদেশের কাছে সরাসরি দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপে সমর্থন জানালেও এর প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যে জড়িত নয়, সেটি উজরা জেয়া স্পষ্ট করেই বলেছেন।
কিন্তু সংলাপে সরাসরি জড়িত না থাকলেও উজরা জেয়া ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অংশীদার হিসেবে নির্বাচনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। ‘সহায়ক ভূমিকা’ বলতে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন—এমন এক প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিকের ভাষ্য হচ্ছে, কূটনীতিতে ভাষার কিছু মারপ্যাঁচ থাকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যখন অংশীদার হিসেবে নিজেদের ‘সহায়ক ভূমিকার’ কথা বলছে, তখন তা থেকে তাদের ভবিষ্যৎ একটা আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উজরা জেয়ার সৌজন্য সাক্ষাৎ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় হয়েছে। যেখানে তাঁদের মধ্যে গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আলোচনায় শ্রম অধিকার ও নাগরিক অধিকারের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন উজরা জেয়া।
একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ এর আওতায় পড়েননি। যুক্তরাষ্ট্র এটি বাংলাদেশকে জানিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে। তবে প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন সরকারের এই মেয়াদে হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব ও বিশেষায়িত এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ নিয়ে দুই পক্ষের সম্পর্কে একধরনের অস্বস্তি বজায় ছিল। বাংলাদেশের ওপর নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানা জল্পনা ছিল।
কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমায় র্যাবের প্রশংসা করেছিলেন। ডোনাল্ড লুর ওই বক্তব্য সরকারের মধ্যে স্বস্তি এনেছিল। সরকারি মহল মনে করেছিল, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেবে না যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু মার্কিন ওই কূটনীতিকের সফরের চার মাস পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। উজরা জেয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে এবার ঢাকায় এসেছিলেন ডোনাল্ড লু।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, উজরা জেয়া ঢাকায় এসে নির্বাচন ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে যে বার্তা দিয়ে গেলেন, সেটিকে সরকার হয়তো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছে। দুই পক্ষের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিশেষ করে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার ওপর হয়তো নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া।