‘কথার কথা’ বলে একটি বিষয় আছে রাজনীতিতে। এটি অনেকটা এ রকম—বলতে হয়, তাই বলা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীরা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে এখন যা বলছেন সেসব ‘কথার কথা’ কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে।
এর কারণ সরকারি নথি অনুযায়ী, বেনজীর আহমেদ এখনো দেশের ‘শ্রেষ্ঠ সৎ’ মানুষদের একজন। পুলিশের মহাপরিদর্শক থাকা অবস্থায় মূলত নীতি–নৈতিকতা ও সততার জন্য সরকার তাঁকে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেনজীর আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, এর সাড়ে ছয় মাস পর সরকার তাঁকে মহিমান্বিত করেছে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দিয়ে।
সরকারি পদ–পদবি ব্যবহার করে বেনজীর আহমেদ অবিশ্বাস্য সব দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন—বিশ্বাসযোগ্য এসব তথ্য প্রকাশের পরও তাঁর ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ কেন সরকার বাতিল করছে না সে প্রশ্ন এখন উঠেছে।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
বলে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেনজীর আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, এর সাড়ে ছয় মাস পর সরকার তাঁকে মহিমান্বিত করেছে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ দিয়ে। মর্যাদাপূর্ণ এই স্বীকৃতি বেনজীর আহমেদ পেয়েছিলেন ২০২০-২১ সালের জন্য। তিনি পুরস্কার হাতে পেয়েছেন ২০২২ সালের জুন মাসে।
সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ কাউকে পুরস্কার বা স্বীকৃতি দেওয়ার পর যদি তাদের মনে হয় বিষয়টি যথাযথ হয়নি, সে ক্ষেত্রে ওই পুরস্কার বা স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থাকে।মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত সচিব
সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় আর যা–ই হোক সততার জন্য বেনজীর আহমেদ যে কোনো পুরস্কার পেতে পারেন না, এ নিয়ে এখন আর কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। অথচ এখনো তাঁর ঝুলিতে ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কার রয়ে গেছে। পুরস্কার হিসেবে তিনি সনদ, ক্রেস্ট ও এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পেয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রধানদের মধ্যে ‘শুদ্ধাচার পুরস্কারের’ জন্য তাঁকে ২০২২ সালে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
শুদ্ধাচার বলতে সরকার আসলে কী বুঝায়, সেটি একটু জেনে নেওয়া দরকার। সরকারি নথি অনুযায়ী, শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর মাধ্যমে একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ বোঝানো হয়—কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও চরিত্রনিষ্ঠা।
‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করেছিল। এ–সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয় ২০১৭ সালে। এরপর থেকে সততার মানদণ্ডে ‘শুদ্ধ’ থাকা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচরীদের প্রতিবছর এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
‘শুদ্ধ মানুষের’ পুরস্কার বুঝে পাওয়ার মাত্র দুই বছরের মধ্যে সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে গত মে মাসে অনেকটা গোপনে সপরিবার দেশ ছেড়েছেন বেনজীর আহমেদ। তিনি দেশ ছাড়ার পর তাঁর ‘শুদ্ধতা’ নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ এখন প্রশ্ন তুলছেন। এমনকি তাঁর কোনো দুর্নীতির দায় সরকার নেবে না বলেও ঘোষণা দিচ্ছে।
‘কাছের লোক’ থেকে বেনজীর আহমেদ এখন হয়ে গেছেন ‘কার লোক’। যে কারণে ‘শুদ্ধ’ বেনজীরের পরিচয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে হয়ে গেছে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ। ৬ জুন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ডেকেছিল দুদক। তিনি আসেননি। এরপর ৯ জুন তাঁর পরিবারের সদস্যরাও দুদকের ডাকে সাড়া দেননি। অবশ্য তিনি ও তাঁর পরিবার দুদকের কাছ থেকে সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। তাঁদের আবেদন মঞ্জুরও হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) হয়ে থাকলে বেনজীরের ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ এখনই বাতিল করে সরকার চাইলে সবার প্রতি ‘বার্তা’ দিতে পারে।
অবশ্য অনেকেই বলতে পারে, সরকারের ‘ইশারা’ না থাকলে বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দুদকের ‘নজরে’ পড়ত না। এই মত মেনে নিলেও তাঁর ক্ষেত্রে ‘বক্তৃতার’ বাইরে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে সরকারের। দুদকের ‘নজরে’ থাকার পরও সরকার চাইলে ‘নজির’ তৈরি করতে পারে বেনজীরের।
শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বোঝায়। এর মাধ্যমে একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্যও বোঝানো হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে এর অর্থ বোঝানো হয়—কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও চরিত্রনিষ্ঠা।
সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়ার মতে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা–কর্মচারীকে বিশেষ কোনো কারণে সম্মান বা স্বীকৃতি দেওয়া হলে, সেটি ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারী অবসরে গেলেও সরকার তা প্রত্যাহার করতে পারে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ কাউকে পুরস্কার বা স্বীকৃতি দেওয়ার পর যদি তাদের মনে হয় বিষয়টি যথাযথ হয়নি, সে ক্ষেত্রে ওই পুরস্কার বা স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বিবেচনায় নেবে। তদন্তে প্রমাণ (অসততা বা দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার) পেলে সেই পুরস্কার সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করতে পারে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী, বেনজীর আহমেদের ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ প্রত্যাহারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, সেটিই এখন প্রশ্ন।
ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো