আমলাতন্ত্র নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিজম তৈরি করা হয়েছে

‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ নিয়ে জাতীয় সংলাপের দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তারা। ২৭ ডিসেম্বরছবি: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনিক অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘খুব সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আমলাদের বক্তব্যে শুনতে পাচ্ছি যে তাঁরা একধরনের হুমকি দিচ্ছেন। এটার একটা সাহস পেয়েছেন বিগত সময়গুলোতে। আমরা দেখেছি, আমলাদের কীভাবে শক্তিশালী করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিজম তৈরি করা হয়েছে।’

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ নিয়ে জাতীয় সংলাপের দ্বিতীয় অধিবেশনে (রক্তের ঋণ ও ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা) বক্তব্য দেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। এ সংলাপের আয়োজক ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ। দুই দিনের সংলাপের প্রথম দিন ছিল গতকাল।

খুব সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আমলাদের বক্তব্যে শুনতে পাচ্ছি যে তাঁরা একধরনের হুমকি দিচ্ছেন।
মো. নাহিদ ইসলাম, উপদেষ্টা, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়

বিভিন্ন ক্যাডারের চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে সংলাপে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘যাঁরা এ রকম আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমলাদেরও আমরা বলছি যে এখন সময় জনগণকে সময় দেওয়ার। আমাদের যে গণতান্ত্রিক ট্রানজিশনটা (রূপান্তর), সেটাকে সঠিকভাবে করতে সহায়তা করা। আন্দোলন-আন্দোলন খেলা কিংবা তাঁদের গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার জন্য কিন্তু এত মানুষ জীবন দেয়নি।’

বক্তব্য দেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

রাষ্ট্রের সংস্কার হলে সবাই ন্যায়বিচার পাবে, সেই সংস্কারে তাঁদের (আন্দোলনকারী সরকারি কর্মকর্তারা) কথাও শোনা হবে বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটা সংস্কারের মত আসলেই তাঁরা যে রিঅ্যাকশন (প্রতিক্রিয়া) দেখিয়েছেন, মনে করি এটা তাঁদের নৈতিকভাবেও ঠিক হয়নি এবং তাঁরা বিধিগতভাবে লঙ্ঘন করেছেন। দ্বিতীয়ত, বিগত রেজিমের (শাসনব্যবস্থা) যেসব আমলা লুকিয়ে আছেন নানাভাবে এখনো, তাঁদেরও আমরা চিহ্নিত করেছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে। তাঁদের বিরুদ্ধেও খুবই দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, বিগত রেজিমের মৌলিক সমস্যার জায়গাটা ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে, সেসব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনকালে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় একটা টেনশন তৈরি হয়। সামনের যে বাংলাদেশ, সেখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটা যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, গণতান্ত্রিকভাবে হয়, সেটি করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ বারবার রক্ত দিয়েছে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হয়নি। ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটা কতটা গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ বা প্রাতিষ্ঠানিক করা যায়, সেটা আমাদের প্রধান একটা এজেন্ডা। নির্বাচনের আগে এই প্রশ্নের সুরাহা হওয়া প্রয়োজন যে এরপর যে সরকার আসবে, তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া কী হবে?’

ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়াসহ কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ঐক্য সব সময় ধরে রাখতে হবে বলে মনে করেন নাহিদ ইসলাম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশনীতিতে ঐকমত্য প্রয়োজন। রাষ্ট্রের একক বিদেশনীতি থাকবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা যায়, একেক দল এলে বৈদেশিক নীতি একেক রকম হয়ে যায়। একদল এলে ভারতমুখী সরকার হয়, আরেক দল এলে সেটা ভারতবিরোধী বা অন্য দেশমুখী সরকার—এভাবে পোর্ট্রেট (চিত্রিত) হয়। বিদেশনীতিও নতুনভাবে চিন্তা করা উচিত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দুর্নীতিবিষয়ক নীতির বিষয়েও একধরনের ঐকমত্য প্রয়োজন।

সরকারকে যদি বারবার প্রশ্ন করা হয়, সমালোচনা করা হয়, তাহলে সরকারের গতি বাড়ে।
মো. মাহফুজ আলম, উপদেষ্টা

‘সমালোচনায় সরকারের গতি বাড়ে’

সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের আরেক উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার বসার জন্য আগ্রহী। বসে ঠিক করা যে কতটুকু সংস্কার করা হবে এবং কোন সংস্কারগুলো করলে ঐক্য থাকে। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি দাঁড় না করাতে পারেন, তাহলে ঐক্য দিয়ে কী করবেন? রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে মূলত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বাহাত্তরের সংবিধানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠান হওয়ার সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে অনেক ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোকে যদি সংস্কার করে রাষ্ট্রের বা জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তাহলে জাস্ট সরকার বদল বা রদবদলের জন্য এটা আসলে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ হবে না। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত কোন কোন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় কোন কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাব। ঐকমত্যে পৌঁছে ওই প্রতিষ্ঠানের কতটুকু আমরা সংস্কার করে যাব।’

বক্তব্য দেন উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম
ছবি: প্রথম আলো

উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘আমরা চাই সরকারকে মানুষ অ্যাকাউন্টেবল (জবাবদিহি) করুক। সরকারকে যদি বারবার প্রশ্ন করা হয়, সমালোচনা করা হয়, তাহলে সরকারের গতি বাড়ে। এটা আমরা সরকারে গিয়ে দেখেছি। সে জন্য খুবই স্ট্রং ক্রিটিক (কঠোর সমালোচনা) থাকা, অ্যাকাউন্টিবিলিটির (জবাবদিহি) ভেতরে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারকে সহযোগিতা করার উপায় হচ্ছে যৌক্তিক সমালোচনা এবং পর্যালোচনা করা, যার কারণে সরকারের কার্যক্রম গতিশীল হবে এবং জনগণ উপকৃত হবে।  

সরকারের জায়গা থেকে মাঠের কথা শোনা হচ্ছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো সময় লাগছে, তবে শোনা হচ্ছে। এখন শিক্ষার্থীরা অনেকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। তারপরও যারাই মাঠে আছে, তাদের কথা সরকার শুনছে।

প্রাধান্য ঠিক করতে হবে

যত দিন পৃথিবী থাকবে, তত দিন সংস্কার হবে, কিন্তু তত দিন অন্তর্বর্তী সরকার থাকবে না, কাজেই অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রাধান্য ঠিক করতে হবে বলে উল্লেখ করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন আলোচনা করার পরামর্শ দেন সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক। তিনি বলেন, তাহলে এই সরকার মানুষের কথা বুঝতে পারবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের তরুণ নেতৃত্বের দিকে সবার দৃষ্টি থাকে উল্লেখ করে এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান বলেন, ‘এক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের পক্ষ থেকে একজন বলছিলেন, আমাদের কাছে সরকারি কর্মকর্তারা অনেক সময় বলেন যে একজন সমন্বয়ককে দিয়ে যদি ফোন করান, তাহলে খুব ভালো হয়। মানে তদবিরের জন্য আরকি। এটা একটা নেগেটিভ কথা। কিন্তু আমি মনে করি, এই যে তরুণদের নতুন এমপাওয়ারমেন্ট (ক্ষমতায়ন) যেটা হয়েছে, সেটা আমাদের জন্য নতুন আলোকবর্তিকা এবং এই তরুণেরাই পারবে আমাদের পরিবর্তন করতে।’

সংলাপে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিনের উদ্দেশে অধ্যাপক নাদিন শান্তা মুরশিদ বলেন, ‘আপনারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে আমরা আপনাদের কাছ থেকে রক্তপাত ছাড়া পরিবর্তন পেতে পারি? ধরেন, আপনাদের একটা নীতি করলেন, আমাদের সেটা পছন্দ হলো না। আমরা রাস্তায় নামলাম, বললাম—এটা হবে না। আপনারা কি না মেরে আমাদের কথা শুনবেন?’
এই প্রশ্নের জবাবে মাহাদী আমিন বলেন, ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাজনীতির সংস্কৃতি পরিবর্তন। ৫ আগস্টের পর যখন সেই অর্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল না, তখন বিএনপি এলাকায় এলাকায় সুরক্ষা দিয়েছে। অনেকে ভয় পেয়েছিল লাশের বন্যা বয়ে যাবে, তার কিছুই হয়নি। ভবিষ্যতে বিএনপি স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চায়।

সংলাপের এই অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান (আযাদ), আইনজীবী রোকসানা খন্দকার, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল, মানবাধিকারকর্মী ইলিরা দেওয়ান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম। সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ।