আর কিছুক্ষণ পরেই কুমিল্লা-ময়মনসিংহে ভোট, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে চিন্তা
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র দুই মাসের মাথায় ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ভোট আজ। এর মধ্যে কুমিল্লায় ভোট হচ্ছে শুধু মেয়র পদে। অন্যদিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়াদ অবসান হওয়ায় সেখানে মেয়র ও কাউন্সিলরের সব কটি পদে ভোট হচ্ছে। দুই সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কতটা হবে, তা নিয়ে প্রচারের শুরু থেকেই মেয়র প্রার্থীদের অনেকে নিজেদের চিন্তা ও শঙ্কার কথা বলে আসছিলেন।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাগজের ব্যালটে ভোট হলেও ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় আজ শনিবার ভোট হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। এর আগে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে কোথাও কোথাও ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল ভোটারদের। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এবং আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা না করায় এবার দুই সিটির নির্বাচন অনেকটা ‘নির্দলীয়’ হতে যাচ্ছে। মেয়র নির্বাচনে এবার দলীয় প্রতীক না থাকায় কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দুজন ও ময়মনসিংহে তিনজন নেতা প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ না নিলেও কুমিল্লায় ভোটের আলোচনায় আছে বিএনপিও।
ময়মনসিংহে বিএনপির কেউ প্রার্থী না হলেও কুমিল্লায় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত দুই নেতা প্রার্থী হয়েছেন। ফলে কুমিল্লায় বিএনপির ভোটাররাও জয়–পরাজয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন বলে আলোচনা আছে। অন্যদিকে ময়মনসিংহ নগর আওয়ামী লীগে দুটি পক্ষ রয়েছে। দুই পক্ষ থেকেই প্রার্থী থাকায় সেখানে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি সামনে এসেছে।
দুই সিটির ভোটের প্রচারে বড় ধরনের কোনো হামলা–সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটলেও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিরপেক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছেন কুমিল্লা সিটিতে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়া চারজনের তিনজনই। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে হুমকি, ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনসহ সারা দেশে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে (পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদসহ) মোট ২৩১টি নির্বাচন ও উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে আজ শনিবার।
কুমিল্লায় দলীয় ভোট ভাগাভাগি
২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক। মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার দেড় বছরের মাথায় গত ডিসেম্বরে মারা যান তিনি। যে কারণে কুমিল্লায় মেয়র পদে উপনির্বাচন হচ্ছে।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর) আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের প্রার্থী আরফানুল হকের কাছে গত সিটি নির্বাচনে মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরেছিলেন মনিরুল হক (সাক্কু)।
এবার মেয়র পদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে দুই নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাঁরা হলেন তাহসীন বাহার ও নূর উর রহমান মাহমুদ (তানিম)। এর মধ্যে তাহসীন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবা সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন। তাহসীনকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে। আরেক প্রার্থী নূর উর রহমান কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা।
নূর উর রহমান ভোট করছেন হাতি প্রতীকে। তাহসীনের প্রতীক বাস। অন্যদিকে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র মো. মনিরুল হক ও মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন (কায়সার) এবারও মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মনিরুল কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আর নিজাম কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি। মনিরুল হক ‘টেবিলঘড়ি’ ও নিজামউদ্দিন ‘ঘোড়া’ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গত সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন মনিরুল ও নিজাম। তখন দল থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। এখনো তাঁরা বহিষ্কৃত। তবে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীর অনেকে এবারের নির্বাচনেও তাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন।
দলীয় সূত্র বলছে, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপিতে দুটি ধারা। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন উর রশিদ। স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম তাঁর শ্যালক। আরেকটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন মো. মনিরুল হক। স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের দাবি, গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতাতে আমিন উর রশিদ তাঁর শ্যালক নিজামকে প্রার্থী করেন। এবারও একই অবস্থা। এবারও শ্যালককে প্রার্থী করিয়েছেন আমিন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ এ বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ১০ নেতার সঙ্গে মেয়র পদের উপনির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটাররা চার ভাগে বিভক্ত হবেন। একদিকে তাহসীন ও নূর উর রহমান, অন্যদিকে মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিন। গতবারও বিএনপির ভোট মনিরুল হক ও নিজামউদ্দিনে বিভক্ত ছিল। গত নির্বাচনে ভোটের হিসাব অনুযায়ী মনিরুলের পরাজয়ের কারণ ছিলেন নিজাম। অন্যদিকে গত নির্বাচনে বিএনপির দুজন প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ছিলেন আরফানুল হক। এবার তাহসীনের সঙ্গে নূর উর রহমানও প্রার্থী। ফলে দুজনের মধ্যে কম-বেশি ভোট ভাগাভাগির একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন।
ভোটার উপস্থিতি নিয়ে চিন্তায় প্রার্থীরা
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সাধারণত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই কেন্দ্রে ভোটার আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন। এবার কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে কাউন্সিলরদের ভোট না হওয়ায় ভোটের প্রচার ততটা জমেনি। এ অবস্থায় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা নিয়েই চিন্তায় রয়েছেন প্রার্থীরা। অন্যদিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী ও প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে কয়েকজন করে প্রার্থী থাকায় ভোটার উপস্থিতি নিয়ে ততটা চিন্তা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা৷
কুমিল্লার ইপিজেড এলাকার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীরাই ভোটার আনার উদ্যোগ নেয়। আমার ধারণা, কাউন্সিলর ভোট না থাকায় এ নির্বাচনে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোটার কেন্দ্রে যাবেন না।’
কুমিল্লার বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি কারণে এবার মেয়র নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ কম। কারণ, ২০ মাসের মধ্যে কুমিল্লা সিটি এলাকার ভোটারদের জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে তিনবার ভোট দিতে হচ্ছে। এবারের উপনির্বাচন নিয়ে আগ্রহ তাই কম।
অন্যদিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৩টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১৪৯ জন। বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই প্রার্থীর সংখ্যা ৪ থেকে ৬। সর্বোচ্চ ৮ জন প্রার্থী রয়েছেন ৩টি ওয়ার্ডে। কুমিল্লার তুলনায় ময়মনসিংহে ভোটারের উপস্থিতি ভালো হবে ধারণা করা হচ্ছে।
ত্রিমুখী লড়াই নাকি ইকরামুলের ধারাবাহিকতা
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন গঠিত হয়। ২০১৯ সালের ৫ মে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন ইকরামুল হক। এবার নিজ দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁকে।
এবার মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক (টিটু), জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান। তিন প্রার্থীর মধ্যে মূলত মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে প্রচারণার সময়ে। এই তিনজনের বাইরে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন কৃষিবিদ রেজাউল হক ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী শহিদুল ইসলাম।
ময়মনসিংহ নগরের বিভিন্ন এলাকার সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়র পদে আওয়ামী লীগের তিনজন নেতাই ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এর মধ্যে সাদেকুল ও এহতেশামুল শহরের অসহনীয় যানজটসহ নাগরিক সমস্যাগুলো ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছেন। নির্বাচিত হলে তাঁরা দুজনই ময়মনসিংহ শহরের যানজট ও জলাবদ্ধতামুক্ত করার পাশাপাশি হোল্ডিং ট্যাক্সের (গৃহকর) ‘বোঝা’ কমিয়ে দেবেন বলে ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে ইকরামুল হক বিগত পাঁচ বছরে শহরের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে ভোটারদের কাছে ভোট চেয়েছেন। এ ছাড়া করোনা মহামারির সময়ে মানুষের পাশে থাকার বিষয়টিও ছিল তাঁর নির্বাচনী প্রচারে। নির্বাচনী প্রচারণায় এ তিন প্রার্থীর মধ্যে কথার লড়াই ছিল।
ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের একটি অংশের মূল্যায়ন হচ্ছে, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে টানা ১২ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন ইকরামুল। ফলে স্থানীয়ভাবে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাঁর। সেই সঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দলে তাঁর শক্ত অবস্থান রয়েছে। অন্যদিকে তাঁর বিরোধী পক্ষ মেয়র নির্বাচনে একক প্রার্থী দিতে পারেনি। দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ায় সুবিধা পাবেন ইকরামুল। প্রচারেও তিনি অনেকটা এগিয়ে ছিলেন।
দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, ময়মনসিংহ সদর আসনের সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান এবং সাবেক মেয়র ইকরামুলকে দলের ঘিরে নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা বিভক্ত। মোহিত মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ইকরামুল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ছেলে মোহিতের অনুসারীরা ইকরামুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পক্ষে থাকায় কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভোটে মেয়র পদে পাঁচজন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৬৯ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৯ জন প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে মোট ভোটকেন্দ্র ১২৮টি। নির্বাচনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন।
ইভিএম নিয়ে শঙ্কা
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া আমরা সব এলাকায় সাধারণ ভোটারদের শিখিয়েছি। নির্বাচনের দিনও (আজ) শেখানো হবে। আশা করি, ইভিএম কোনো প্রভাব ফেলবে না।’
তবে ইভিএম–পদ্ধতি নিয়ে ময়মনসিংহের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নানা শঙ্কা রয়েছে বলে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা বলছেন।