নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন, তবু চলছে প্রস্তুতি
নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের কোনো মীমাংসা এখনো হয়নি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানে অটল রয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলো। এমন পটভূমিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এখনো অনিশ্চিত। তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিজেদের ঘোষিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী পুরোদমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট ও নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণা করার লক্ষ্যে ইসির প্রস্তুতি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ইসি এখন হালনাগাদ ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ করছে। সারা দেশে ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ নিয়েও ব্যস্ত রয়েছে ইসি।
তবে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুর অনেকটা একই। ইসি বলছে, তারা সরকারসহ সবার প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তারা সক্ষম হবে।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ইসি যখন দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় বিদেশি পর্যবেক্ষক আসার প্রশ্নেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গত বুধবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। এমন অবস্থানের ব্যাপারে ইইউ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছে। ঢাকায় বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বিদেশি পর্যবেক্ষক আসার ক্ষেত্রে ইইউর এ সিদ্ধান্তের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রাক্–পর্যবেক্ষক দল আসছে অক্টোবর মাসে। এই প্রতিনিধিদল পরিবেশ যাচাই করবে। তাদের পর্যালোচনার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠানো না–পাঠানোর প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেবে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে ভিসা নীতি ঘোষণার চার মাসের মাথায় গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র সেই নীতির বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করার কথা জানিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ কী বার্তা দিচ্ছে, এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
নির্বাচনের আগে এখনই পরিবেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার তাদের অবস্থানে অনড় থেকে পরিস্থিতি জটিল করছে।
তবে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সুর অনেকটা একই। ইসি বলছে, তারা সরকারসহ সবার প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তারা সক্ষম হবে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বলছে, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী নির্বাচনে সরকার সব রকম সহায়তা দেবে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী একটি সম্পূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপিসহ আন্দোলনকারী দলগুলো ইসির ভোটের এই প্রস্তুতির কোনো প্রক্রিয়াতেই অংশ নেয়নি। বিএনপি নেতারা বলে আসছেন, যেহেতু তাঁরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবেন না, সে কারণে বর্তমান ইসির ভোটের প্রস্তুতিতে তাঁদের আগ্রহ নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে এখনই পরিবেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার তাদের অবস্থানে অনড় থেকে পরিস্থিতি জটিল করছে।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এখন চলছে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। আগামী মাস থেকে শুরু হবে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ।
চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতিতে ইসি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ইসি। সে অনুযায়ী নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও নির্বাচনী বিধিতে সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজও শেষ। এখন হালনাগাদ ভোটার তালিকা তৈরির কাজ চলছে। গত ২ মার্চ পর্যন্ত সময়ে নিবন্ধিত ভোটারদের তালিকা চূড়ান্ত করা আছে। এরপর যাঁরা নিবন্ধিত হয়েছেন, তাঁদের যুক্ত করে সম্পূরক তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে। সারা দেশে ৪২ হাজার ৩৮০টি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। নির্বাচন সামনে রেখে নতুন দুটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছে ইসি। দেশীয় ৬৬টি সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হবে। এ জন্য এখনো আবেদন নেওয়া হচ্ছে।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এখন চলছে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। আগামী মাস থেকে শুরু হবে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ। সাধারণত তফসিল ঘোষণার পর এই প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। এবার আগেভাগেই প্রশিক্ষণ শুরু করা হচ্ছে। এবার ৩০০ আসনেই ভোট হবে কাগজের ব্যালটে। এ জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
‘অবাধ ভোটাধিকার: প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টের ভূমিকা’ নিয়ে একটি কর্মশালা করতে যাচ্ছে ইসি। আগামী ৪ অক্টোবর এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাংবাদিক, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলিয়ে ১২ জন অংশ নেবেন। ইসি বলছে, নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি রোধে প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্টের ভূমিকা, প্রার্থী কী ধরনের পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করবেন এবং কীভাবে তাঁকে দায়বদ্ধ করবেন—এসব বিষয়ে সেখানে আলোচনা হবে। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি কর্মশালা আয়োজন করার চিন্তা আছে ইসির।
পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করাসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও একই রকম বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে।
তবে ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর কথা জানিয়েছে। গত মঙ্গলবার ইইউ তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করা হবে কি না, তা এই মুহূর্তে যথেষ্ট স্পষ্ট নয়।
ক্ষমতাসীন দলের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টিও মনে করে, এখন পর্যন্ত দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন না তাঁরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারবেন।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য ভোটের পরিবেশ নিয়ে কোনো ধরনের আশঙ্কার কথা মানতে রাজি নয়। গতকাল রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, নির্বাচন কমিশন প্রতিটি পদক্ষেপে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। একজন জেলা প্রশাসক একটি দলের পক্ষে কথা বলায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ রকম যখন যেটা ইসির কানে আসছে, সেটা নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাহিদামতো সহযোগিতা পাচ্ছি: ইইউকে সিইসির চিঠি
ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিঠির জবাব দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল রোববার এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ছোট পরিসরে হলেও একটি দল পাঠাবে।
সূত্র জানায়, ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলিকে লেখা চিঠিতে সিইসি বলেছেন, ‘আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই যে নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছ থেকে তাদের চাহিদামতো সহযোগিতা পেয়েছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে কমিশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। সরকারও বারবার তাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি তুলে ধরছে।’
চিঠিতে সিইসি বলেন, নির্বাচনে যত বেশি দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকবে, নির্বাচন তত বেশি স্বচ্ছ হবে এবং সবার ওপর একধরনের চাপ থাকবে। দেশে–বিদেশে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও এতে বাড়বে।
যা বলছে আ.লীগ–বিএনপি
২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের দুটি নির্বাচন নিয়েই অনেক প্রশ্ন আছে। সংবিধান অনুযায়ী, দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে ইসি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে অনড়। গত শনিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা আরেকটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তিন মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন হবে। নির্বাচন আপনাদের মানতে হবে।’
অন্যদিকে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থানে অটল থেকে এক দফার আন্দোলন করছে। তবে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ইসির পক্ষ থেকে এখনো কোনো উদ্যোগ নেই।