সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আপনারা কোনো পরিকল্পনা কি নিয়েছেন?
এম সাখাওয়াত হোসেন: পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে। ইতিমধ্যে কিছু জিনিস হাতে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ এখনো পর্যাপ্ত বের হয়নি। পুলিশের ওপর আক্রমণ করে নির্মমভাবে অনেক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। যদি কোনো পুলিশের কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, সেটা বিচার হবে তদন্তের মাধ্যমে। জনগণ যদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পুলিশকে এভাবে হ্যারাজ (হয়রানি) করে, হত্যা করে, তাহলে পুলিশ কীভাবে কাজ করবে? স্বভাবতই তারা একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে। সেখানে তাদের দায় যতখানি, হুকুমদাতাদের দায় তার চেয়ে বেশি। যাঁরা হুকুমদাতা ছিলেন, তাঁরা তো দেশের বাইরে চলে গেছেন। এঁদের ব্যবহার করে পেছনে ফেলে গেছেন। এনারা টার্গেট হয়ে গেছেন। এই অবস্থায় পুলিশ বাহিনী, যাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার কথা, তাঁরা মাঠে নেই। তাঁরা ভয়ভীতির কারণে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছেন। এমনকি আমি এটাও জানি, তাঁদের পরিবার না খেয়ে আছে। বাজারে বের হতে পারছেন না। টাকাপয়সা নেই।
একটু সময় লাগবে। ইতিমধ্যে সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সেনাবাহিনী তো পুলিশের মতো কাজ করতে পারবে না। তারপরও সেনাবাহিনী মানুষজনকে বুঝিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেনাবাহিনীরও সীমাবদ্ধতা আছে। পুলিশ যা করতে পারে, তা সেনাবাহিনীকে দিয়ে হয় না। আবার সেনাবাহিনী যা করতে পারে, তা পুলিশ পারে না। তবে ইনশা আল্লাহ আগামী তিন–চার দিনের মধ্যে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে। একটু সময় লাগবে।
পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু দাবিদাওয়া আছে। এসব দাবিদাওয়া এবং বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার কী করবে?
সাখাওয়াত: আমি রাজারবাগ যাব। পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলব। তাঁদের অভিযোগ শুনব। যতটুকু সম্ভব আমি চেষ্টা করব, যাতে তাঁদের অভিযোগগুলো শুনে তাৎক্ষণিক না হলেও যত দিন আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আছি, তার মধ্যে সুরাহার চেষ্টা করব। তাঁদের আশ্বস্ত করতে হবে। তাঁরাও মানুষ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ নেওয়ার মাঝখানের সময়ে কয়েক দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে সরকার কি কোনো ব্যবস্থা নেবে?
সাখাওয়াত: চিন্তাভাবনা আছে। সরকারের পতন এমনভাবে হলো, এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। সাংবিধানিক প্রভিশন না। সম্পূর্ণ ধরনের একটি উত্থান হয়েছে। এটা গণ–অভ্যুত্থানও বলা যাবে না, তার ওপরে যদি কিছু থাকে, এটা তাই। যেখানে শিক্ষার্থীরা অকাতরে জীবন দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিতে পেরেছিল। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সরকার গঠনে কয়েকটা দিন সময় লাগার কারণে আমি নিজেও উৎকণ্ঠায় ছিলাম। ওই সময়ে কিছুটা বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে; অনেক জায়গায় অনেক সমস্যা হয়েছে। আমি এ জন্য ক্ষমাপ্রার্থী, যদিও এটা আমার দোষ নয়। আমি স্বীকার করছি, সরকার গঠন সঙ্গে সঙ্গে হলে ভালো হতো, সেটা হয়নি। তার মানে এই নয় যে এগোনো যাবে না বা সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন ধরনের লোক বেড়ে গেছে, কেউ ডাকাতির নামে, কেউ অন্য পার্টির নামে এগুলো করছে। আমি স্বীকার করছি, দেশে একধরনের বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা আশাবাদী, দেশ এভাবে চলতে পারে না। ঠিক হয়ে যাবে।
দেশের কিছু জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী?
সাখাওয়াত: সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু জায়গায় হামলার কথা শুনেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। তারা যেন এ ধরনের কিছু হতে না দেয়।
এখানে মুশকিল হলো এখনো আমার হাতে ফোর্স নেই। সেনাবাহিনী আর কিছু জায়গায় বিজিবি নিয়ে কাজ চলছে। যেটা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশে আমি মাইনরিটি (সংখ্যালঘু) বলতে কাউকে বোঝাই না, আমরা সবাই বাংলাদেশি। সব জায়গায় একটা অরাজকতা হয়েছে। সবাই মিলে একটা সমস্যায় আছি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার আছে প্রতিবাদ করার। ওনারা প্রতিবাদ করেছেন, এটা নোটিশে আনা হয়েছে। এই মুহূর্তে যত দূর সম্ভব আমরা কিছুতেই এসব ঘটনা ঘটতে দেব না। আমি এটা দৃঢ় ভাষায় বলছি। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হবে, কারা এসব ঘটনায় জড়িত।
এখনো মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাজ করছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কী করবে?
সাখাওয়াত: যেভাবে এত দিন শাসন চলছিল, তাতে রাষ্ট্র ভেঙে পড়েছে। ভয়ংকর শাসন চলছিল। ব্যক্তিশাসন চলছিল, যেখানে মানুষ কথা বলতে পারছিল না। বিচারব্যবস্থা, পিএসসি—সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েছে। দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। গর্ব করে বলছে, আমার পিয়ন চার শ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেধাভিত্তিক নিয়োগ চেয়েছিল। তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন সরকারপ্রধান। যিনি এদের নানি বা দাদির সমান। দেশটাকে ভাগ করলেন রাজাকার আর স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে। আপনার সঙ্গে থাকলে চেতনা, না থাকলে রাজাকার। কথায় কথায় পাকিস্তানপন্থী, এগুলো বলে পুরো দেশকে তছনছ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নামের অপব্যবহার করা হয়েছে। এমন পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে, মানুষ আর ওটাকে সহ্য করতে পারছিল না। মিডিয়া, পুলিশ, বিজিবি ধ্বংস হয়েছে। দলীয় লোক দিয়ে আপনি ফ্যাসিস্ট বাহিনী করেছেন। সরাসরি একটি বিদেশি রাষ্ট্রের ভরসায় আপনি এগুলো করেছেন।
এটা আমাদের দেশ, আমাদের দেশকে অন্যের প্ররোচনায়...যেখানে ওপেনলি (খোলামেলা) বলে, আমি অমুক দেশের প্রার্থী, অমুক দেশ থাকলে আমরা আছি, আমরা আছি তারা আছে। এটা কি একটা দেশপ্রেমী রাজনীতি? এগুলো করে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী একটা দলকে তছনছ করে দিয়েছেন, ব্যক্তিগত পাওয়ার লালসায়। এ অবস্থায় রাষ্ট্র ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে রাষ্ট্রকে বের করে আনতে হবে।
আমরা চেষ্টা করছি, তিন–চার দিনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আপনারা দেখবেন। ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপে আছে। আনসার বাহিনী আছে। বিজিবি বাইরে আছে। জনগণের কাছে অনুরোধ করছি, যারা থানা জ্বালিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করুন। পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করুন।