গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট আজ
জাতীয় নির্বাচনের আগে ইসির ‘পরীক্ষা’ শুরু
ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ বিএনপি ভোটে নেই। এরপরও গাজীপুরের ভোটকে ইসির জন্য একধরনের ‘পরীক্ষা’ বলে নির্বাচন বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
২০১৮ সালে ‘নিয়ন্ত্রিত’ পরিবেশে দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটি নিয়েও ছিল বিতর্ক। এবারও জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পাঁচ সিটির ভোট। যার শুরু হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় এই সিটি করপোরেশন।
২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচনের বড় পার্থক্য হলো ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ভোটে নেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে দলটি অংশও নেয়নি। ফলে এখন পর্যন্ত বর্তমান কমিশনকে খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন পরিচালনা করতে হয়নি। তবে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ক্ষমতাসীনদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাই গাজীপুরের ভোটকে বর্তমান ইসির জন্য একধরনের ‘পরীক্ষা’ বলে নির্বাচন বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, ইসির আস্থা অর্জনের জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে এই নির্বাচন।
ইসির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ‘নৌকা ছাড়া কাউকে ভোটকেন্দ্রে আসতে দেবেন না’ এমন বক্তব্যের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করায় গতকাল ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আজিজুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করে ইসি। যদিও এর আগে একাধিক মেয়র প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়া, হয়রানি ও হামলার মতো বিষয়ে ইসিকে জানানো হলেও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ আছে। আজ ভোটের পরিবেশ কেমন থাকবে, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন অনেক প্রার্থী ও ভোটাররা।
২০১৮ সালে পাঁচ সিটি নির্বাচনে ইসির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারা। তখন মামলা, গ্রেপ্তার, হুমকিসহ নানা কৌশলে ভোটের আগেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঠছাড়া করার অভিযোগ উঠেছিল।
এবার বিএনপিবিহীন গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও প্রচারের সময় পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, কর্মীদের বাধা দেওয়া, গাড়িবহরে হামলার মতো ঘটনায় বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষ থেকে অন্তত ১৫টি অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন তাঁর গণসংযোগে দুই দফায় হামলার অভিযোগ করেন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বাদে অন্য প্রার্থীদের দাবি, ইসি পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি।
আজ ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের নির্বাচনী কার্যক্রম সমন্বয়কারী ও সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই প্রশাসন একজন ব্যক্তির পক্ষে কাজ করছে। প্রচারের সময় ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। নেতা-কর্মীদের বাসায় গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। ভোটকেন্দ্রের বাইরেই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ তৈরি করা হতে পারে।
১০ বছর আগে গাজীপুর সিটির প্রথম মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আজমত উল্লা খান। তিনি বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে পরাজিত হন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম জয়ী হন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি আজমত উল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে। মানুষের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা রয়েছে। একটি পক্ষ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু ভোটাররা সব অপপ্রচারকে মিথ্যা প্রমাণ করেই কেন্দ্রে যাবেন।
আছে শঙ্কা
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ গত এক দশকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচন নিয়ে ছিল প্রশ্ন। নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলে আসছেন, দেশের নির্বাচনী পরিবেশ অনেকটা ধ্বংস হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও মানুষের আস্থা নেই। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তারাই আগামী জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করবে।
বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরের বেশি সময় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ও প্রশ্ন উঠেছে। তারা ‘গোপন বুথে ডাকাত’ ঠেকাতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে এই ডাকাতদের ছবি প্রকাশিত হওয়ার পরও কমিশন তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘গোপন বুথে ডাকাত দেখে’ গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করা ছিল ইসির বড় পদক্ষেপ। কিন্তু কোন প্রার্থীর জন্য গাইবান্ধার ভোটে অনিয়ম করা হয়েছিল, ইসির তদন্তে তা উঠে আসেনি। প্রার্থী, স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের ব্যাপারে কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে অনেক কেন্দ্রের গোপন কক্ষে অবৈধ ব্যক্তি অবস্থান করছেন, গণমাধ্যমে এমন ছবিও এসেছে। তবে ইসি এসব অপরাধে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
জাতীয় নির্বাচনের ছায়া সিটি নির্বাচনে
নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘নিয়ন্ত্রিত’ পরিবেশ শব্দটা পরিচিতি পায় পাঁচ বছর আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। সে সময় বিরোধী প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের হুমকি, নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগে বাধা, কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জটলা, পরিকল্পিতভাবে কেন্দ্র দখলে রাখা এবং ভোটার উপস্থিতি সীমিত রাখা ছিল এই নিয়ন্ত্রণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ওই নির্বাচনের পরিস্থিতি বর্ণনা করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, ‘...এটা বুঝতে পারলাম যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে মডেল ধরে সরকারি দল কৌশল সাজিয়েছে।’
এবারের সিটি নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন কমিশনকে বড় কোনো চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে না। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করা সহজ হবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ হলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
এবারের সিটি নির্বাচনে এমন কোনো কিছু হবে না বলে ইসির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, যেকোনো মূল্যে গাজীপুরে একটি মডেল নির্বাচন উপহার দেওয়া হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে সব প্রার্থীর এজেন্টের অবস্থান নিশ্চিত করা হবে। আইনের ভেতরে থেকে প্রার্থীদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা তাঁরা পাবেন।
দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরে তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন ভোটারের এই সিটিতে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের ৩ হাজার ৪৯৭টি কক্ষে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত বিরতিহীন ভোট গ্রহণ চলবে। প্রতিটি কেন্দ্রে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করেছে ইসি। মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত মিলিয়ে তিন পদে মোট প্রার্থী ৩৩৩ জন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এবারের সিটি নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন কমিশনকে বড় কোনো চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে না। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করা সহজ হবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ হলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, বিকল্প বিশ্বাসযোগ্য প্রার্থী নেই। তবে এসব নির্বাচন থেকে ক্ষমতাসীন দল কী বার্তা পেল, তার প্রভাব থাকবে জাতীয় নির্বাচনে। তাদের প্রার্থীরা জিতলে একরকম আর সুষ্ঠু নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হেরে গেলে, সেটি হবে আরেক রকম।