ভারত দুঃসময়ের বন্ধু, চীন থেকে শেখার আছে

  • অর্থ বানিয়ে লাভ কী, শেষে দেশেই থাকা যায় না।

  • ইউনূসের মামলায় সরকারের দায় নেই।

  • শেখ হাসিনা কারও সঙ্গে ‘জেলাসি’ করে না।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল গণভবনেছবি: বাসস

ভারতকে দুঃসময়ের বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে বলেছেন, চীন থেকে শেখার আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ মনে করল এদিকে ঝুঁকলাম নাকি ওদিকে ঝুঁকলাম। আমি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি।’

গতকাল মঙ্গলবার গণভবনে ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সূচনা বক্তব্যে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরের অর্জনের কথা তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন

ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়নে কার সঙ্গে কতটুকু বন্ধুত্ব দরকার, সেটা করে যাচ্ছে সরকার। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়—বাংলাদেশের এমন পররাষ্ট্রনীতির বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেন। বলেন, ‘ভারত আমাদের চরম দুঃসময়ের বন্ধু। আবার চীন যেভাবে নিজেদের উন্নত করেছে, সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সেগুলো সামনে রেখে সম্পর্ক বজায় রেখে যাচ্ছি। আমি সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চীন আমাকে দাওয়াত দিয়েছে, আমি চীনে যাব। আমি যাব না কেন? বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই চলব। কার কী ঝগড়া, সেটা তাদের সঙ্গে থাক। আমার না। দেশের মানুষের কতটুকু উন্নতি করতে পারি, সেটাই আমার।’

আরও পড়ুন

তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য চীন ও ভারত উভয় দেশ প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই আমি বিবেচনা করব কোন প্রস্তাবটা দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে, আমি সেটাই করব। কোন প্রস্তাব নিলে আমি ঋণ কতটুকু নিলাম, শোধ করলাম, দিতে কতটুকু পারব। সবকিছু বিবেচনা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভারত যখন বলছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ পাঠাবে, অবশ্যই তারা আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখব। চীনও একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে। যেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য, লাভজনক—সেটাই করব।’

একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত যদি প্রকল্পটা করে দেয়, তাহলে সব সমস্যার সমাধানই হয়ে যায়। ভারতের সঙ্গে যদি তিস্তা প্রকল্পটা করা হয়, তাহলে পানি নিয়ে আর সমস্যা থাকে না।

আরও পড়ুন

৫৪টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়ে গেছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, চীনেরও পানি তুলে নেওয়ার ঘটনা আছে। হিমালয় রেঞ্জের নদীগুলো নিয়ে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব আছে, সমস্যা আছে; আবার সমাধানও আছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তা শুধু পানি ভাগাভাগির বিষয় নয়। গোটা তিস্তা নদীটাকে পুনরুজ্জীবিত করে উত্তরাঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা করা, অধিক ফসল যাতে হয়, নৌপথ সচল করার ব্যবস্থা করা হবে। গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়নের জন্য আলোচনা হবে। ভারতের কারিগরি দল আসবে।

আরও পড়ুন

মমতাসহ সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো

তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও গঙ্গা চুক্তির নবায়নে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া চিঠির বিষয়ে প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লিখেছেন ওনার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। এটা তাঁদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এখানে আমার তো কিছু বলার নেই। এ ব্যাপারে আমার কোনো নাক গলানোর দরকারও নেই। আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো। একটা কথা বলতে পারি, ভারতের দলমত-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।’

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করে না

ভারতকে বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ার সমালোচনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শেখ হাসিনা এ দেশকে বিক্রি করে না। কারণ, আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি। যারা বিক্রির কথা বলে, তারা একাত্তর সালে পাকিস্তানের দালালি করেছিল।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা দেশের মধ্যে ট্রানজিট দিলে ক্ষতিটা কী? রেল যেগুলো বন্ধ ছিল, তা আস্তে আস্তে খুলে দেওয়া হয়েছে; যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হচ্ছে। ওই অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হচ্ছে, তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমরা কি চারদিকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকব? সেটা হয় না। ইউরোপের দিকে তাকান, সেখানে কোনো বর্ডারই নেই, কিছুই নেই। তাহলে একটা দেশ আরেকটা দেশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে?’

আরও পড়ুন

অর্থ বানিয়ে লাভটা কী

দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে কমিশন গঠন-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু মানুষ তো লোভী হয়ে যায়। টাকাপয়সার লোভ এত বেড়ে যায় যে দেশ রেখে বিদেশে রাখতে গিয়ে শেষে দেশ ছেড়েই ভাগতে হয়। এতই অর্থ বানিয়ে ফেলল যে শেষে আর দেশেই থাকা যায় না। তাহলে অর্থ বানিয়ে লাভটা কী হলো? এটা তো মানুষ চিন্তা করে না। বোধ হয় নেশার মতো পেয়ে যায়।’

ব্যাংক খাতে যেটুকু সমস্যা হচ্ছে, তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাংকিং খাত কেউ ভালো চালাচ্ছেন; কেউ খারাপ চালাচ্ছেন। অনেকে ঠিকমতো চালাতে পারেন না। যদি কোনো ব্যাংক দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে তাকে সহযোগিতা করতে হয়। একটা ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটা ব্যাংককে একীভূত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ কিন্তু সরকারের দায়িত্ব। সেটাই পালন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

ইউনূসের মামলায় সরকারের দায় নেই

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত নিবন্ধ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি বিষয়টি দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে যে মামলা, তা সরকার করেনি। কল্যাণ ফান্ডের টাকা না দেওয়ার কারণে শ্রমিকেরা শ্রম আদালতে মামলা করেছেন। সেই মামলায় মুহাম্মদ ইউনূস শাস্তি পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এখানে আমার কী দোষ?’

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনা ঈর্ষান্বিত নন

টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ আছে, সরকার ইউনূসের বিরুদ্ধে সব যন্ত্রই ব্যবহার করেছে। এ বিষয়ে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনটি তিনি পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আবার লিখেছে যে নোবেল প্রাইজের জন্য তাঁর সঙ্গে আমার...আমার সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব নেই। নোবেলের জন্য আমার কোনো আকাঙ্ক্ষাও নেই। আর লবিস্ট রাখার মতো টাকাও নেই। আমি কখনো ওটা চাইনি।’

এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের আমলে করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি হওয়ার পরে দেশে-বিদেশে অনেক নোবেল লরিয়েটরা আমার জন্য লিখেছেন। কই আমি তো কখনো তদবির করতে যাইনি। কারও কাছে বলতেও যাইনি। কী পেলাম, না পেলাম ওইগুলি আমার মাথার মধ্যেও নেই। যিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করলেন, ব্যাংকের একজন এমডি। তিনি যখন নোবেল প্রাইজ পান, তাঁর সঙ্গে আমি কনটেস্ট করতে যাব কেন?’

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনা বলেন, ‘পৃথিবীতে যত শান্তি চুক্তি হয়েছে বের করেন! শান্তি চুক্তি হয়েছে কয়টা অস্ত্রধারী আত্মসমর্পণ করেছে? আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু শান্তি চুক্তিই করিনি, ১ হাজার ৮০০ জন অস্ত্রধারী ক্যাডার আমার কাছে অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। আমি তাদের সবাইকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে পুনর্বাসন করেছি। ৬৪ হাজার শরণার্থী ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছি।’

নোবেল পুরস্কার নিয়ে তাঁর কোনো ঈর্ষা নেই জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘শেখ হাসিনা কারও সঙ্গে জেলাসি করে না। শেখ হাসিনা ফাদার অব নেশনের মেয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। অন্তত এই জায়গাটায় কেউ আসতে পারবে না। সেটাই আমার গর্ব। প্রধানমন্ত্রী এটা তো সাময়িক ব্যাপার। ওনার (ইউনূস) সঙ্গে আমার জেলাসির কী আছে।’

সংবাদ সম্মেলন মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর এক পাশে ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। অন্য পাশে ছিলেন সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।