বুয়েটে ছাত্ররাজনীতিতে বাধা থাকছে না
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকছে না। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সাড়ে চার বছর আগে বুয়েট কর্তৃপক্ষের জারি করা ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র কার্যক্রম স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এ–সংক্রান্ত এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার রুলসহ এ আদেশ দেন।
শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর ওই ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ জারি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ। এর বৈধতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন সোমবার রিটটি করেন।
ইমতিয়াজ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
বুয়েট কর্তৃপক্ষের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এতদ্বারা সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিষিদ্ধ করা হলো।’ এ বিজ্ঞপ্তি কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, হাইকোর্টের দেওয়া রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব, বুয়েটের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম হারুনুর রশীদ খান। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম (সুজন) শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ২০১৯ সালে বিজ্ঞপ্তি দেয়। কোন আইনে, কেন ও কিসের বলে এটি করা হলো, এর কোনো কারণ বলা হয়নি। এটি চলমান (রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা) রয়েছে, যে কারণে রিট আবেদনকারী সংক্ষুব্ধ। ১৯৬১ সালের বুয়েট অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে। রাজনৈতিক সংগঠনের নামে ভিন্নতর কিছু করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করার কোনো ক্ষমতা অধ্যাদেশে তাদের দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞপ্তিটি সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, ওই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ক্ষমতার চর্চা করেছে, এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের উৎস আইনে তাদের নেই। যে কারণে বিজ্ঞপ্তিটি এখতিয়ারবহির্ভূত। রুল ও বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিতের প্রার্থনা জানান তিনি।
ওই বিজ্ঞপ্তি সংবিধান ও বুয়েট আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নূরুল ইসলাম।
আদালতের আদেশের পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আদালত রুল দিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেছেন। ফলে বুয়েটে এখন থেকে ছাত্ররাজনীতি করায় আর কোনো বাধা থাকল না।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে হলের ভেতরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় আদালত ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। আবরারকে পিটিয়ে হত্যার পর বুয়েট কর্তৃপক্ষ ওই ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ জারি করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়।
এর প্রায় সাড়ে চার বছর পর গত ২৭ মার্চ মধ্যরাতের পর ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান, এমনটি উল্লেখ করে ২৯ মার্চ আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁরা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২৭ মার্চ মধ্যরাতের পর ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগতদের’ প্রবেশ ও রাজনৈতিক সমাগমের ‘সংগঠক’ শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটের হল থেকে তাঁর সিট (আসন) বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
অন্যদিকে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবিতে ৩১ মার্চ দুপুরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। সমাবেশে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি একটি কালো আইন। এই আইন সংবিধানবিরোধী।
৩১ মার্চ সমাবেশের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে যান। তাঁরা বুয়েট শহীদ মিনারের পাশে স্থাপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালে (প্রতিকৃতি) ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এর কিছু সময় পর তাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গতকাল হাইকোর্টে বুয়েটের ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র বৈধতা নিয়ে রিট করা হয়।
হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত
হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সোমবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে বুয়েটে ক্যাস্পাসে শহীদ মিনারের পাশে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে (প্রতিকৃতি) ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। এ সময় তাঁরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন।
সেখানে ছাত্রলীগের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ও বুয়েটের সদ্য সাবেক ছাত্র হাসিন আজফারসহ ১১ শিক্ষার্থী ছিলেন। শ্রদ্ধা জানানোর সময় শহীদ মিনারের পাশে অবস্থান করছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আশিক আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘জয় বাংলা স্লোগান ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে আমরা এই রায়কে সাধুবাদ জানালাম। প্রগতিশীল সব সংগঠনকে আমরা বুয়েটে স্বাগত জানাই। অন্ধকার কোনো সংগঠন এবং স্বাধীনতাবিরোধী কোনো চেতনা বুয়েটে ঠাঁই পাবে না।’
এ সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাসিন আজফার বলেন, ‘বুয়েট ক্যাম্পাসে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু এখানে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো মতাদর্শের উত্থান আমরা হতে দেব না।’
রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা
বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের আকাঙ্ক্ষার কথা আবারও জানিয়েছেন। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে বুয়েটের উপাচার্য সত্যপ্রসাদ মজুমদারের কাছে তাঁরা এ আরজি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘বুয়েট প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি, এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত বিচার বিভাগে যথাযথভাবে তুলে ধরা হোক।’
বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে এ সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান তিন শিক্ষার্থী। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমরা বুয়েটের শিক্ষার্থীরা দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান ও আস্থা রাখি। বুয়েট ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ২৭ মার্চ মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে বহিরাগত রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আগমন এবং শোডাউনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালার লঙ্ঘন বলে মনে করে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।’
বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বুয়েট যদি মনে করে, তারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। এরপর বুয়েটের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন সব ধরনের সাংগঠনিক রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করে। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমরা বুয়েট প্রশাসনের কাছে দাবি রাখব যে এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত বিচার বিভাগে যথাযথভাবে তুলে ধরা হোক।’
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘যে ছাত্ররাজনীতি র্যাগিংয়ের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ শিক্ষার্থীদের, তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না।’
ছাত্ররাজনীতিবিহীন বুয়েটের পরিবেশ সর্বোচ্চ নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব ছিল উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘মৌলবাদী শক্তিকেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দিতে পারি। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আমাদের বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও ইতিমধ্যে আমাদের ক্যাম্পাস ছাত্ররাজনীতিমুক্ত রাখার মতামতের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে একাত্মতা পোষণ করছেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজ নিজ জায়গা থেকে তাঁরা আমাদের পক্ষে তাঁদের অবস্থান ব্যক্ত করছেন।’
বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের প্রতি পূর্ণ ভরসা ও আস্থা রাখেন উল্লেখ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘যেসব শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিয়েছেন, আমরা গত চার বছরে এমনটা কখনো অনুভব করিনি যে তাঁরাও চান পুনরায় ছাত্ররাজনীতি প্রবেশ করে সেই অন্ধকার দিনগুলো ফিরে আসুক। আমরা বুয়েটের সব শিক্ষকের কাছে আরজি জানাচ্ছি, তাঁরা যেন এমন সংকটের মুহূর্তে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। আমরা উপাচার্য স্যারের ওপর আস্থা পোষণ করি। তাঁর সদিচ্ছা সব সময় আমাদের পক্ষে ছিল বলেই আমরা বিশ্বাস করি।’
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমরা উপাচার্য স্যারকে এই আরজি জানাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে নিয়ে আপামর বুয়েট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের যে আকাঙ্ক্ষা, তা সব আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি যেন পূরণ করেন।’