২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

নয়াপল্টনে অভিযানে বিএনপির ৩০০ নেতা-কর্মী আটক, ১৬০ বস্তা চাল জব্দ

বিএনপির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ৩০০ নেতা-কর্মী আটক করা হয়েছে
ছবি: দীপু মালাকার

১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ কোথায় হবে, এ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্যেই গতকাল বুধবার বিকেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর নয়াপল্টন। সংঘর্ষে মকবুল আহমেদ নামে একজন নিহত এবং অর্ধশত বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থক আহত হন। এর মধ্যে ২৬ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

বিএনপি বলছে, নিহত মকবুল আহমেদ রাজধানীর পল্লবী থানার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। তবে মকবুলের বড় ভাই আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মকবুল বিএনপির সমর্থক ছিল। তিনি জুতার নকশার কারিগর ছিলেন।

সংঘর্ষের পর নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবির, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস ও ছাত্রদলের সাবেক নেতা আবদুল কাদের ভূঁইয়াসহ কয়েক শ নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত চলে আটক অভিযান। পুলিশ কার্যালয়ের ভেতরে তল্লাশি চালায়, যা শেষ হয় রাত নয়টায়। এরপর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ নয়াপল্টনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এই অভিযানে ৩০০ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে।

গতকাল রাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নয়াপল্টনে নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশের হামলা, গুলি ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে জেলা ও মহানগরে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি।

বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ রাত সাড়ে ১১টায় প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার সমাবেশকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে পুলিশ উসকানি দিয়ে হামলা চালিয়েছে। একজনকে মেরে ফেলেছে। অনেককে আহত করেছে। তিনি বলেন, দেশে যে পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে, এ ঘটনার তার প্রমাণ এবং পুলিশ যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে সেটার নজির সৃষ্টি করল।

এর আগে বিকেলে কক্সবাজারে জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের আগেই রাজপথে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে। তারা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সংঘর্ষ সূত্রপাত হয় বেলা পৌনে তিনটার দিকে। এর আগে সকাল থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে দলের নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। তারা সেখানে সরকার বিরোধী নানা স্লোগানে মিছিল শুরু করছিলেন। একপর্যায়ে জমায়েত বড় হয়ে রাস্তার এক পাশ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। এ সময় পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে নেতা-কর্মীরা সংঘর্ষে জড়ান। একপর্যায়ে পুলিশ শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে আশ্রয় নেন। অনেকে আশপাশের গুলিতে ঢুকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মারতে শুরু করেন। পুলিশও গলিতে ঢুকে পাল্টা শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে তাদের ধাওয়া দেয়। এ সময় দুপক্ষের সংঘর্ষে নয়াপল্টন এলাকায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

সংঘর্ষের সময় নয়াপল্টনেই ছিলেন ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সৈয়দা সুমাইয়া। পুলিশ ধাওয়া দিলে তিনি বিজয়নগর এলাকায় আশ্রয় নেন। বিকেল পৌনে চারটার দিকে সৈয়দা সুমাইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পার্টি অফিসের সামনে মিছিল করছিলাম। অতর্কিতে দুই পাশ থেকে পুলিশ এসে আমাদের ঘিরে ফেলে হামলা চালায়, ছররা গুলি, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। আমাদের বেশ কয়েকজন ভাই আহত হয়েছেন। এরপর যেদিকে যাকে পেয়েছে পুলিশ তুলে নিয়েছে।’

বিকেল সাড়ে চারটায় পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ের ফটক বন্ধ করে দিয়ে অভিযান শুরু করে। এ সময় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও বোম ডিসপোজাল ইউনিটের পোশাকে বেশ কিছু সদস্যকে কার্যালয়ে ঢুকতে দেখা যায়। এর কিছু সময়ের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কার্যালয়ের সামনে পৌঁছান। তিনি ভেতরে ঢুকতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। তখন কার্যালয়ে ঢুকতে না পেরে সামনের ফুটপাতে বসে পড়েন মির্জা ফখরুল। তিনি সন্ধ্যা পাঁচটার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে আমার কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ পুলিশ, তাদের বোম ডিসপোজাল ইউনিটের লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আমরা সন্দেহ করছি, তারা ভেতরে বোমা জাতীয় কিছু রেখে এর দায় আমাদের ওপর চাপাবে।’

পরে বিএনপির মহাসচিবের সামনেই দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে থাকা সব নেতা-কর্মীকে একে একে আটক করে পুলিশ নিয়ে যায়। সবাইকে নিয়ে যাওয়ার পর (প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর) মির্জা ফখরুল রাস্তা থেকে উঠে যান। যাওয়ার আগে রাত আটটার দিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাগে করে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি পুলিশ কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে গেছে।

মির্জা ফখরুল চলে যাওয়ার ১০ মিনিট পর পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ের ভেতর থেকে পাঁচটি ককটেল উদ্ধার করে ফটকে এনে নিষ্ক্রিয় করে। এরপর আরও দুই দফায় ককটেল নিষ্ক্রিয় করা হয়। রাত নয়টায় পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, মোট ১৫টি ককটেল নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, নয়াপল্টনের কার্যালয়ে পুলিশ অভিযান শুরু করলে নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কক্ষে দরজা লাগিয়ে ভেতরে অবস্থান নেন। এ সময় বাইরে থেকে দরজা ভাঙার শব্দ শোনা যায়। পরে পুলিশ দরজা ভেঙে নেতা-কর্মীদের বের করে নিয়ে যায়। নয়াপল্টনের রাস্তায় পড়ে থাকা অন্তত অর্ধশত মোটরসাইকেল ভ্যানে করে পুলিশকে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

রাত ৮টার দিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে চলে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ আমাদের কার্যালয়ে থেকে সিসি ক্যামেরার হার্ডডিস্ক নিয়ে গেছে যাতে হামলার কোনো আলামত না থাকে। শুধু তাই নয়, তারা অফিসের মধ্যে ঢুকে সবকিছু ভাঙচুর করেছে। দলের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে। একাত্তরের হানাদার বাহিনীর মতো বিএনপি নেতা কর্মীদের ওপর হামলা করেছে।’

এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মাহমদুর রহমান মান্না ও সাইফুল হকসহ গণতন্ত্র মঞ্চের একদল নেতা নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশ বিজয়নগর নাইটিঙ্গেল মোড়ে তাঁদের আটকে দেয়। এর আগে এবি পার্টির সদস্যসচিব মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলকেও সেখান থেকে ফেরত দেওয়া হয়।

নয়াপল্টনে একজন নিহত

নয়াপল্টনে নিহত ব্যক্তির নাম মকবুল আহমেদ। তাঁর বাসা ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধ এলাকায়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

সংঘর্ষের সময় নয়াপল্টনে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। তিনি বিএনপির আহত নেতা-কর্মীদের উদ্ধারে কাজ করেছেন। নিহত মকবুল আহমেদকে তিনি হাসপাতালে নিয়েছেন। তিনি প্রথম আলো বলেন, বিএনপির কার্যালয়ের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে মকবুল আহমেদকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বিকেল পৌনে চারটায় তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত মকবুলের শরীরে ছররা গুলির আঘাতের অনেকগুলো চিহ্ন রয়েছে।

সংঘর্ষে কতজন আহত হয়েছেন, তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত মকবুলসহ ২৬ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে এক পুলিশ ও দুই বিএনপির নেতাকে ভর্তি করা হয়। বাকিরা জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। আহত ব্যক্তিদের প্রায় সবার শরীরে কমবেশি ছররা গুলির চিহ্ন রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও অনেককে নেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

আহতদের মধ্যে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রবিন খানের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

এ ছাড়া একজন সাংবাদিকও আহত হন বলে জানা গেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নয়াপল্টনে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ নয়াপল্টনে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে-এ নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন শহীদউদ্দিন চৌধুরী। তাঁকেও আটক করা হয়। আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার আলোচনার জন্য তাঁকে যেতে বলেছিলেন। এ জন্য তিনি দলীয় কার্যালয় থেকে বের হন। এর পর তাঁকে ডিবি পুলিশ আটক করে নিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। জোর করে সমাবেশ করতে চাইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মিরপুর কালশী মাঠ, পূর্বাচল, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা কোথাও বড় মাঠ পেলে বিএনপি সমাবেশ করতে পারবে।

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, ঢাকার সমাবেশ বানচাল করার জন্য ক্ষমতাসীন দল গত কয়েক দিন ধরে নানা হুমকি-ধামকি দিচ্ছিল। নয়াপল্টন সমাবেশ করার জন্য আবেদন করলেও তারা বিএনপিকে জোর করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাঠানোর চেষ্টা করছিল। শুরু থেকেই এ নিয়ে তাদের সন্দেহ জেগেছে। এখন বিএনপি যাতে সমাবেশ করতে না পারে, তার জন্য তিন দিন আগে বিনা কারণে পুলিশ দিয়ে নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

এই অবস্থায় ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক করে ঠিক করা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এ পরিস্থিতিতে সমাবেশ করা কী সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করেই তো এগুলো হচ্ছে। তারা (সরকার) সমাবেশটা নষ্ট করার চেষ্টা করছে।’