সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাংবিধানিক দায়িত্ব। অনিয়ম উদ্ঘাটন করে নির্বাচন বন্ধ করা দায়িত্ব নয়। এ অভিমত ব্যক্ত করে সম্প্রতি বন্ধ হওয়া গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলেছে, গোপন কক্ষে ‘ডাকাত’ পড়ার আশঙ্কা এবং সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্ভাব্য অসহযোগিতার কথা কমিশনের সদস্যদের জানার কথা। কারণ, তাঁরা তো মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেননি। তাই আগে থেকেই নির্বাচন বন্ধ করার ব্যবস্থা না নিয়ে এগুলো ঘটতে দেওয়ায় সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক।
আজ শনিবার দুপুরে ‘কী বার্তা দিল গাইবান্ধা আসনের উপনির্বাচন’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ বক্তব্য তুলে ধরেছে সুজন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেল। প্রথমবারের মতো আমাদের জানামতে, এ দেশের ইতিহাসে একটি সংসদীয় আসনের নির্বাচন, যদিও তা ছিল উপনির্বাচন, সেটি মাঝপথে স্থগিত করা হলো। এ সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে সাধুবাদ জানাই।
তবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গাইবান্ধার উপনির্বাচন এমন এক সময় হয়েছে, যখন নির্বাচন কমিশন, নিজের স্বীকারোক্তিতেই চরম আস্থার সংকটে ভুগছে। বর্তমান কমিশনের নিয়োগের ব্যাপারে ছোট দলগুলোর কিং-মেকার হওয়ার অভিযোগ, তরীকত ফেডারেশনের আবারও একাধিক কমিশনারের নাম সফলভাবে প্রস্তাব করার দাবি, অনুসন্ধান কমিটির পক্ষ থেকে কারা কার নাম প্রস্তাব করেছে তা প্রকাশে ও রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা চূড়ান্ত ১০ জনের নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি ইত্যাদি কারণে শুরু থেকেই সন্দেহ ও বিতর্ক নিয়ে আউয়াল কমিশনের যাত্রা শুরু হয়।
সুজন সম্পাদক বলেন, নির্বাচন কমিশনের আটঘাট বেঁধে, ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে গাইবান্ধা উপনির্বাচনে ভোট ডাকাতি উদ্ঘাটনের সর্বাত্মক চেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখলেও, এটি প্রশ্নের উদ্রেক না করে পারে না। কারণ, অতীতে যেকোনো নির্বাচন শেষে সাধারণত নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম অনিয়মের অভিযোগ তুললেও কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হওয়ার দাবি করা হতো। যেমন ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর তখনকার ইসি সচিব মো. আলমগীর (বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার) বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যম থেকে যেটুকু দেখেছি এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন পেয়েছি, আমরা বলব, ভালো নির্বাচন হয়েছে।’ অথচ তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনিয়মের নির্বাচনের একটি মডেল’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
বিশেষ করে গাইবান্ধা–৫ উপনির্বাচনটিতে সহজে জয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া, এ জন্য লজ্জিত না হওয়ার পরিবর্তে কমিশনের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতি অবিচার করার জোরালো অভিযোগ তোলা এবং অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে অনেক প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছ থেকে সাদা কাগজে ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’ এমন প্রত্যয়ন নেওয়ার নজিরবিহীন পদক্ষেপ ওই সন্দেহকে ঘনীভূত না করে পারে না—বলেন বদিউল আলম মজুমদার।
গাইবান্ধা–৫ উপনির্বাচন নিয়ে কমিশনের কঠোরতার কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আর প্রয়োজন নেই—একজন মন্ত্রীর এমন বক্তব্যেও জনগণ সন্দিহান হতে বাধ্য বলে মনে করে সুজন। সুজন বলছে, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে কমিশনের পক্ষ থেকে কারচুপি উদ্ঘাটনের নজিরবিহীন প্রচেষ্টা ও ক্ষমতাসীনদের কমিশনের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ তোলা উভয় পক্ষের জন্যই ‘উইন-উইন’। এর মাধ্যমে আউয়াল কমিশন যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং তারা যে ক্ষমতাসীনদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয়, তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আশা করা যায়, বিষয়টি কাকতালীয়। যদি তা না হয়, তাহলে এ নাটকে প্রযোজকের কূটবুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যায় না। কারণ, এর মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
উপনির্বাচনের পর গণমাধ্যমের সামনে দেওয়া বক্তব্যে কমিশন কয়েকটি বিষয়ে আবারও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে বলে মনে করে সুজন। এর ব্যাখ্যায় সুজন বলছে, প্রথমত, তারা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে যে ইভিএম নিয়ে একমাত্র সমস্যা হলো ভোটের গোপন কক্ষে ‘ডাকাতের’ উপস্থিতি। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের সুরম্য ভবনে স্যুট–কোট পরে বসে থাকা এবং ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের দিয়ে প্রযুক্তিগতভাবে এ দুর্বল যন্ত্র ব্যবহার করে সম্পূর্ণ গোপনে যে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব—তা সুকৌশলে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন যে ভোটে কারচুপির মোক্ষম সমাধান হলো ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে যেখানে অন্তত ৪৫ হাজার কেন্দ্র থাকবে এবং নির্বাচনী কক্ষ হবে কয়েক লাখ, সেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করার আশা কল্পনাকেও হার মানায়।
সুজন সম্পাদক বলেন, গাইবান্ধা উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আবারও প্রমাণিত হলো, দলীয় সরকারের অধীনে একটি সাধারণ উপনির্বাচনও যার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল হবে না, কমিশনের পক্ষে সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সীমাহীন দলীয়করণ।
গাইবান্ধা উপনির্বাচন থেকে বার্তা হলো, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতি ঠেকাতে হলে কমিশনকে তাদের হাতে থাকা নিউক্লিয়ার অপশন আবারও ব্যবহার করতে হবে, নির্বাচন বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষমতা কমিশনের থাকলেও এর ব্যবহার কারও কাম্য নয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই জাতীয় নির্বাচন স্থগিতের সম্ভাবনা এড়াতে হলে কমিশনকে এখনই সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে বলতে হবে যে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা কমিশনের সম্ভব হবে না—বলেন, বদিউল আলম মজুমদার।
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘আমরা আশা করতে চাই, গাইবান্ধা-৫ আসনে কমিশন যা করেছে, তা কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরানোর কোনো বৃহত্তর প্লটের অংশ নয়। তবে ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়, তেমনি নির্বাচন কমিশনের আমাদের ভোটাধিকার হরণের একের পর এক অপচেষ্টার কারণে আমরা সন্দিহান না হয়ে পারি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আরও আশা করতে চাই যে গাইবান্ধা উপনির্বাচনে কমিশনের দেখানো কঠোরতা ‘‘টু-লিটল-টু-লেইট’’ (সমস্যা ঠেকাতে যথেষ্ট না করা ও সমস্যা গুরুতর হওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া) নয়। তা অবশ্য বহুলাংশে নির্ভর করবে এ থেকে তারা কী শিক্ষা নেয় ও কী উদ্যোগ গ্রহণ করে তার ওপর।’