নির্বাচনে জিততে ‘নৌকা’ চান জাতীয় পার্টির নেতারা

জাতীয় পার্টি

নির্বাচনে অংশ নিয়েও স্বস্তিতে নেই জাতীয় পার্টি (জাপা)। কারণ, দলটির নেতাদের বড় একটি অংশ নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা চান। সে জন্য তাঁরা নৌকা প্রতীকও চান।

জাপার নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একদিকে দলীয় মনোনীত প্রার্থী দিয়েছে। অন্যদিকে প্রায় সব আসনে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখে নির্বাচনের মাঠ জটিল করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নামে-বেনামে থাকা প্রার্থীদের সরিয়ে না নিলে জাপার নির্বাচনে জেতার সুযোগ কম। তাই জাপার অধিকাংশ নেতাই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

এ ক্ষেত্রে দলের বর্তমান সংসদ সদস্যসহ নেতাদের বড় একটি অংশ গত দুবারের মতো এবারও সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে যেতে চান। কারণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও তাঁদের জেতার সম্ভাবনা নেই। তাঁরা সমঝোতার মাধ্যমে ভোট করে সহজে জিততে চান। এই অংশ এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে কোনো সমঝোতার উদ্যোগ না দেখে অস্বস্তিতে রয়েছে।

এই মুহূর্তে জাপার জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে একমাত্র মহাসচিব মো. মুজিবুল হক (চুন্নু) ছাড়া প্রায় সবার আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছে। আবার সব আসনে আওয়ামী লীগ–দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীও আছেন। এর মধ্যে মুজিবুল হকের কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাসিরুল ইসলাম খানের মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে বাতিল হয়েছে।

এ ছাড়া জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের, জ্যেষ্ঠ নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন, ফখরুল ইমাম, সালমা ইসলাম, শামীম হায়দার পাটোয়ারীসহ উল্লেখযোগ্য সব নেতার আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। জি এম কাদের ও তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদের রংপুর ও ঢাকার তিনটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন। তিনটিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে।

এর মধ্যে জি এম কাদেরের রংপুর-৩ আসনে তুষার কান্তি, ঢাকা-১৭ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শেরিফা কাদের প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা-১৮ আসনে। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য হাসান হাবীব। এই আসনে ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীর শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক খসরু চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

গত দুটি (২০১৪ ও ২০১৮ সাল) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে অংশ নেয় জাপা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি ২২টি আসনে, তার আগে ২০১৪ সালে ২৯টি আসনে জয়ী হয়।

জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আসন সমঝোতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিগগিরই জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। গত রাতে জাপার জ্যেষ্ঠ কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হতে পারে। সেটি কবে কখন, বলতে পারব না। (প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে) দেখা হলে নির্বাচন কীভাবে হবে, নির্বাচনটা যাতে সঠিক ও যথাযথ হয়, সে কথা বলব আমরা।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগে থাকা জাপার নেতাদের বড় একটি অংশ সংসদ সদস্য হতে সরকারের সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করছে। এই চেষ্টায় খুব সাড়া না পাওয়ায় সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে তাঁরা এরই মধ্যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে বলছেন, নৌকা প্রতীক না দিলে এবার তাঁরা নির্বাচন করবেন না। যাতে সরকার জাপার সঙ্গে আসন ভাগাভাগি বা নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগ নেয়।

নেতাদের এই অংশ মনে করে, বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো ভোটে না যাওয়ায় এবারের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরকার এমনিতেই বেকায়দায় আছে। সেখানে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাপা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে সরকার আরও বিপদে পড়ে যাবে। সুযোগটি নিতে চান ওই নেতারা।

সব দলেরই একটা (নির্বাচনে) কৌশল থাকে। সব কথা তো বলা যাবে না।
মুজিবুল হক, মহাসচিব, জাপা

গত দুটি (২০১৪ ও ২০১৮ সাল) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে অংশ নেয় জাপা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি ২২টি আসনে, তার আগে ২০১৪ সালে ২৯টি আসনে জয়ী হয়। সরকারি দল সমঝোতার উদ্যোগ নিলে জাপা ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কমপক্ষে ৪০টি আসন দাবি করবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

জাপার নেতা–কর্মীদের অনেকে জানিয়েছেন, একসময় দেশের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে দলের ভালো প্রভাব ছিল। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনে সমঝোতা করে সংসদ সদস্য হওয়ায় এখন এসব এলাকায় জাপার সেই সাংগঠনিক প্রভাব বা সমর্থন নেই। ফলে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া অধিকাংশ নেতারই ভোটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা নেই।

এবার জাপা দলীয়ভাবে এক ভিন্ন রকম প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে গেছে। এবার দলের মনোনয়ন হয়েছে জি এম কাদেরের একক কর্তৃত্বে। মনোনয়ন–বিরোধের জেরে নির্বাচন থেকে ছিটকে গেছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদ ও তাঁর ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদসহ তাঁর অনুসারীরা। অনেক দিন ধরে দলে রওশন-জি এম কাদের বিরোধ চলছিল। এবারের নির্বাচন ঘিরে প্রথমবারের মতো দলটিতে দলীয় প্রধানের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলো, যা দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়েও সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রওশনদের এই ছিটকে পড়া বা তাঁর অনুসারীদের মনোনয়ন অগ্রাহ্য করার পেছনে কোনো সমঝোতা থাকতে পারে। সেটি হচ্ছে, দলের মনোনয়নে রওশন এরশাদের কোনো প্রভাব থাকবে না, নির্বাচনে জাপা বিরোধী দল হলে দলীয় প্রধান হিসেবে জি এম কাদের সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন—সরকারের সঙ্গে এমন সমঝোতা হয়ে থাকতে পারে। কারণ, বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না জানিয়ে নির্বাচন প্রশ্নে ধোঁয়াশা তৈরি করেছিলেন জি এম কাদের। অন্যদিকে রওশন শুরু থেকেই ছিলেন নির্বাচনের পক্ষে। অবশেষে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাপা নির্বাচনে যায়। এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা করছেন।

এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির কৌশল কী হতে পারে, এ নিয়ে জানতে চাইলে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব দলেরই একটা (নির্বাচনে) কৌশল থাকে। সব কথা তো বলা যাবে না।’ সর্বশেষ গত রাত সোয়া ১১টার দিকে জাপার মহাসচিব বলেন, তাঁদের সঙ্গে আজ বুধবার আওয়ামী লীগের নেতাদের বৈঠক হতে। এ বৈঠকে আসনের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।