নিবন্ধন পেতে যাওয়া বিএনএমের পেছনে বিএনপির সাবেক নেতারা
দেশের নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে চলা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপির সাবেক দুই নেতা। দুই বছর আগে গঠিত এই দলের আহ্বায়ক কমিটিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের আধিক্য রয়েছে। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ৩৮০ বর্গফুটের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে।
বিএনএম দলটি গঠিত হয় ২০২১ সালের ৭ জুলাই। গঠনের দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে দলটি। বিএনএমের সঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) নামের আরেকটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সোমবার এই দুই দলের বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। অনেকটাই অপরিচিত দল দুটির নিবন্ধন পাওয়ার সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।
বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। দলের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য।
বিএনএম গঠনের সময় থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা ছিল। এই দল গঠনকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীনদের ‘ষড়যন্ত্রের’ সূত্রপাত হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। তাঁদের আশঙ্কা, বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে বিএনএমের ব্যানারে বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হতে পারে। নির্বাচনের আগে আগে বিএনএমের নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত আলোচনাকে আরও উসকে দিয়েছে।
তবে দলের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো দলের সঙ্গেই আলোচনা হয়নি। কোনো নির্দিষ্ট দলের লোক নিয়ে বা দল ভেঙে নিজেদের দল করার পরিকল্পনাও নেই। তবে দল ইসির নিবন্ধন পাচ্ছে। এখন অন্য দলের কেউ যদি যোগ দিতে চান, তাঁকে স্বাগত জানানো হবে।
দলের নেতৃত্বে বিএনপির সাবেক নেতারা
বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুর রহমান বর্তমানে বেসরকারি প্রাইম ইউনির্ভাসিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও ডিন। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-১ আসনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি হেরে যান।
আব্দুর রহমান বরগুনার বেতাগী থানা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, আব্দুর রহমান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য। ১৯৯৬ সালে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। পরে দলের রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।
বিএনএমের সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ ২০২১ সালের ২৮ জুন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। হঠাৎ হানিফের দল ছাড়ার ঘটনাকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলেছিলেন বিএনপির নেতারা। দল ছাড়ার ১০ দিনের মাথায় নতুন দল বিএনএম গড়ে তোলেন হানিফ। হানিফের সংসদীয় এলাকা সিরাজগঞ্জ-২। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপিরও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যা দেখা গেল
ইসির নিবন্ধন পেতে ৯৩টি দল গত বছরের অক্টোবরে আবেদন করেছিল। এর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে ১২টি দলের কাগজপত্র সঠিক পায় ইসি। ইসির তালিকায় বিএনএমের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা পুরানা পল্টনের একটি ভবনে। রোববার বিকেলে ওই ভবনে গিয়ে বিএনএমের কার্যালয় পাওয়া যায়নি।
পরে দলের সদস্যসচিব মুঠোফোনে জানান, তাঁরা দলের কার্যালয় বদল করেছেন। চিঠি দিয়ে ইসিতে ঠিকানা বদলের বিষয়টিও জানিয়েছেন। তিনি মহাখালীতে অবস্থিত দলের নতুন কার্যালয়ের ঠিকানা দেন।
সন্ধ্যায় মহাখালীতে গিয়ে দেখা যায়, বিমানবন্দর সড়কের পাশেই একটি চারতলা ভবনের চতুর্থ তলায় বিএনএমের কার্যালয়। ছোট দুই কক্ষের কার্যালয়ের একটিতে অফিস, আর আরেকটি মিলনায়তন। দুই কক্ষ মিলিয়ে কার্যালয়টি ৩৮০ বর্গফুটের। মিলনায়তনে ২২টি চেয়ার পাতা। দলের নিবন্ধন পাওয়ার দিনেও কোনো নেতা-কর্মীর উপস্থিতি নেই। সুনসান কার্যালয়ের ভেতরে এটি দেখভালে থাকা একজন ব্যক্তি বসে ছিলেন।
কার্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলে এই কার্যালয়ে আসে বিএনএম। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা এই অফিস পরিদর্শন করেছেন। এই কার্যালয়ের মাসিক ভাড়া ১৫ হাজার টাকা।
সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের আধিক্য
বিএনএম গঠনের পর থেকে ৩৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে। এই কমিটির বেশির ভাগই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও আইনজীবী। এর মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা নয়জন।
সদস্যসচিব মেজর (অব.) মো. হানিফ ছাড়াও দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে আছেন মেজর জেনারেল (অব.) এহতেশাম-উল হক। সদস্য হিসেবে আছেন মেজর (অব.) মো. ইমরান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. আলমগীর হোসাইন, মেজর (অব.) এ কে এম সাঈদুর রহমান, ক্যাপ্টেন (অব.) আবুল কাশেম, মেজর (অব.) মিজানুর রহমান, মেজর (অব.) শিবলী মোহাম্মদ সাদেক ও মেজর (অব.) মো. তৌহিদুর রহমান চাকলাদার।
এ বিষয়ে মো. হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের মূল উদ্যোক্তা আমি ও ব্যারিস্টার সারোয়ার। আমাদের পরিচিতিজনদের নিয়ে দলের কমিটি করা হয়েছে। তাই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে।’
ঘরোয়া কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ কর্মসূচি
বিএনএমের নেতারা জানান, দল গঠনের পর থেকে তাঁদের সব কর্মসূচিই ঘরোয়া ছিল। বাইরে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেনি দলটি। ফলে খুব বেশি আলোচনাতেও তাঁরা ছিলেন না। এখন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। ঘরোয়া কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকায় খুব বেশি ব্যয় নেই দলটির। দলের সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের টাকাতেই মেটানো হচ্ছে খরচ।
নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে যে ১২টি দল টিকেছিল, সেগুলোর কয়েকটি মাঠের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। কিন্তু তারা নিবন্ধন পাচ্ছে না। এ বিষয়ে বিএনএমের সদস্যসচিব মো. হানিফ বলেন, ‘আপনি পুরো পরীক্ষার খাতা লিখলেন, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তাহলে কী হবে? দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে ইসির যে নিয়ম, সেখানে মিছিল-মিটিংয়ের কথা বলা নেই। ইসি যা যা করতে বলেছে, তাই করেছি।’
নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার
দল হিসেবে বিএনএমের ৪৭ দফার ঘোষণাপত্র রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের ১৩ ধারায় বলা আছে, নির্বাচন হবে দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে। বর্তমানে বিএনপিসহ বিরোধী দল ও জোট নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ক্ষেত্রে বিএনএমের অবস্থান কী—জানতে চাইলে দলের সদস্যসচিব মো. হানিফ বলেন, নিবন্ধন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে দলের অবস্থান কী হবে, তা কিছুদিনের মধ্যেই দলের কেন্দ্রীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
‘তবে আমরা একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই,’ বলেন তিনি।