বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল থেকে সরবে না আওয়ামী লীগ
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণা হলেও বিএনপিসহ বিরোধীদের চাপে রাখার কৌশল থেকে সরে আসবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমনকি বিরোধীদের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচিও অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকবেন। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।
দলীয় সূত্র বলছে, মার্কিন ভিসা নীতির পর প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরে যাতে অস্বস্তি ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়েও আওয়ামী লীগ সতর্ক।
একই সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের কাছে বিষয়টি নিয়ে যাতে কোনো ভুল বার্তা না যায়, সেটিও খেয়াল রাখা হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের চাঙা রাখা এবং বিএনপির ওপর চাপ ধরে রাখতে ঢাকায় নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক এবং ঢাকার বাইরে তৃণমূল পর্যন্ত সভা-সমাবেশ করা হবে। এসব কর্মসূচিতে বড় জমায়েত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা দলের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভা করেন। এ সভার মূল লক্ষ্য ছিল বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি তৈরির কৌশল প্রণয়ন।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী সূত্র মনে করছে, ঈদুল আজহার পর বিএনপি ঢাকায় জমায়েত, অবস্থানসহ বড় কর্মসূচির ডাক দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিকে সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে দেখাতে চাইবে তারা। কিন্তু আওয়ামী লীগ উল্টো চাপে ফেলতে পারলে বিএনপি বড় জমায়েত করতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী সূত্র মনে করছে, ঈদুল আজহার পর বিএনপি ঢাকায় জমায়েত, অবস্থানসহ বড় কর্মসূচির ডাক দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিকে সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে দেখাতে চাইবে তারা। কিন্তু আওয়ামী লীগ উল্টো চাপে ফেলতে পারলে বিএনপি বড় জমায়েত করতে পারবে না।
গতকালের যৌথ সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি এখন যেকোনোভাবে দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ আক্রমণকারী। এ সময় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কাজেই কোনো অবস্থাতেই মাথা গরম করবেন না। আক্রমণকারী হবেন না।’ তিনি আরও জানান, দলীয় প্রধানের নির্দেশ হচ্ছে সব জেলা, মহানগর, ইউনিয়নে—প্রয়োজনে ওয়ার্ড পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির দুজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো অবস্থাতেই বিএনপিকে ছাড় নয়—এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, কোনো ছাড় ও আলোচনার দরকার হলে সেটা ওপরের দিকে হবে। কিন্তু রাজপথের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যাবে না।
সাংগঠনিক কর্মসূচির চেয়ে মাঠে জোর
দলীয় সূত্র বলছে, এখন থেকে সাংগঠনিক কাজের চেয়ে নির্বাচনী প্রচার ও বিরোধী দলকে কোণঠাসা করার কর্মসূচিতে বেশি জোর দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ জন্যই ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড কমিটি এখনই ঘোষণা করা হচ্ছে না।
নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকবেন দলের নেতা-কর্মীরা। এটি একই সঙ্গে দলের কৌশল এবং নির্বাচনী প্রস্তুতিরও অংশ।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অধীনে ২৪টি থানা, ৭৫টি ওয়ার্ড এবং ৫টি ইউনিয়ন রয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তরের অধীনে ২৬টি থানা, ৬৪টি ওয়ার্ড ও একটি ইউনিয়ন রয়েছে। এর বাইরে ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত কেরানীগঞ্জ, সাভার ও ধামরাই উপজেলার তৎপরতাও বাড়ানো হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, দুই মহানগরের থানা ও ওয়ার্ডগুলোতে সম্মেলন হয়েছে এক বছর আগে। কিন্তু এখনো কমিটি গঠন করা হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে দ্রুত কমিটি করার বিষয়ে একাধিকবার প্রকাশ্যে সমাবেশে তাগিদ দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তবে দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে কমিটি দেওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, কমিটি হলে দলের ভেতরে বিভক্তি বাড়তে পারে। এ জন্য বিরোধীদের চাপে রাখতে দলের সবার সম্মিলিত শক্তি চাইছে আওয়ামী লীগ।
নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, বিরোধীদের আন্দোলন কর্মসূচি বিবেচনায় রেখে দলের সব স্তরে ঐক্য দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য ওলামা লীগের মতো বদনাম কামানো সংগঠনকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত অনেককে দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাকে দাঁড় করিয়ে বিজয়ী করার পর সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রতিও কঠোর হচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বরং তাঁকে কাছে টেনে নেওয়ার একধরনের চেষ্টা আছে দলের ভেতর।
কাজেই কোনো অবস্থাতেই মাথা গরম করবেন না। আক্রমণকারী হবেন না।ওবায়দুল কাদের
একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভিসা নীতি বিএনপিকে বেশি বিপদে ফেলবে, এটি মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনে ইতিমধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। বিরোধীদের আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনই ঠেলে দিলে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়, তা-ও পরিষ্কার নয়। তাই এখন দল ও সহযোগী সংগঠনের শক্তি দেখানো হচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আশ্বস্ত হবে।
দল ও সরকারের মনোবল চাঙা রাখা লক্ষ্য
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের আগে আলোচনা ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিষেধাজ্ঞা আসছে। তখন নিষেধাজ্ঞা আসেনি। বিএনপিও সরকারের ওপর তেমন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, তা বিএনপিকে আরেকবার সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
ভিসা নীতি এবং বিএনপির চাপ কীভাবে সামলানো হবে—এই প্রশ্ন ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন ও সম্পাদকমণ্ডলীর তিনজন নেতার কাছে। তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে আগামী চার-পাঁচ মাসে অনেক ‘মাইন্ড গেম’ হবে। এর মধ্যে যারা নিজেদের অনমনীয় প্রমাণ করতে পারবে, তারাই নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ মার্কিন ভিসা নীতিকে বিএনপির জন্য নেতিবাচক হয়েছে বলে প্রচার করার কৌশল নিয়েছে। মার্কিন পদক্ষেপ বিএনপির নির্বাচন ভন্ডুলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথেও বাধা সৃষ্টি করবে, সেটি জোরালোভাবে হচ্ছে।
পাশাপাশি রাজপথে নেতা-কর্মীদের সক্রিয়তা আরও বাড়ানো হবে। এভাবে সব জায়গায় বিএনপিকে চাপে রাখতে নির্বাচনের সময় সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে থাকবেন দলের নেতা-কর্মীরা। এটি একই সঙ্গে দলের কৌশল এবং নির্বাচনী প্রস্তুতিরও অংশ।