প্রকাশ্যে শক্তি দেখালেও ভেতরে ভেতরে চাপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
‘প্রতিহিংসার শিকার’ হওয়ার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। অন্যদিকে ‘অস্তিত্বসংকটের’ প্রশ্ন বিবেচনায় নিতে হচ্ছে বিএনপিকে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলই এখন যার যার অবস্থানের সমর্থনে প্রকাশ্যে শক্তি প্রদর্শনের পথে এগোচ্ছে। তবে দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ-উত্তেজনা রয়েছে। একধরনের স্নায়ুচাপেও পড়েছে দুই দল।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিকে ‘অস্তিত্বসংকটের’ প্রশ্ন বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগকেও ‘প্রতিহিংসার শিকার’ হওয়ার বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে। দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের ছয়জন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষ শক্তির পরীক্ষায় জয়ী হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সংকট গভীর হবে। দুই দলই মনে করছে, নিজ অবস্থান থেকে একটু নমনীয় মনোভাব প্রকাশ পাওয়ার অর্থই ‘পরাজয়’। এমন পরিস্থিতিতে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মূলত চিন্তায় আছে, প্রতিহিংসার শিকার হওয়া নিয়ে। অন্যদিকে ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির চিন্তা টিকে থাকা নিয়ে। এই পরিস্থিতি দুই পক্ষকে ভেতরে-ভেতরে একধরনের স্নায়ুচাপে ফেলেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এখন দুই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত তৎপরতা, অন্যদিকে বিরোধী দলের আন্দোলন—দুই দিকই সামাল দিতে হচ্ছে তাদের। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার সঙ্গে দলটি বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো মূল্যে তাদের সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে সংবিধান মেনে নির্বাচন সম্পন্ন করতে তাঁরা প্রস্তুত। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে নানা ধরনের প্রত্যাশার চাপ তৈরি হয়। এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটও যোগ হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ চাপ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে।
অন্যদিকে বিএনপি তাদের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে কি পারবে না, তা দলটির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। সারা দেশে মামলার শিকার হওয়া হাজারো নেতা-কর্মীর চাপ রয়েছে আন্দোলনের পরিণতি দেখার। বিএনপি দাবি করছে, তাদের ৪৩ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলা রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দলটি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানে অটল থেকে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে।
আওয়ামী লীগ চাপ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এখন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। একতরফা নির্বাচন করার সরকারের উদ্যোগ মানুষ মেনে নেবে না। সরকারের একগুঁয়েমির কারণেই পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।
দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান এবং রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা সমঝোতার সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা মনে করেন, ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, দুই পক্ষই অস্তিত্বের সংকটের ভয় থেকে এ মুহূর্তে কোনো ছাড় দেওয়ার অবস্থানে নেই।
রাজপথে কর্মসূচির বিকল্প দেখছে না বিএনপি
গত বছরের জুলাই থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত হাজারো নেতা-কর্মীকে যখন মামলার বোঝা বইতে হচ্ছে, তখন লম্বা সময় ধরে রাজপথের কর্মসূচি টেনে নেওয়া বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জের। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, সরকার এখন বিএনপির প্রতি আরও কঠোর হতে পারে। প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের কৌশল ঠিক করতে হচ্ছে বলে বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন।
যেকোনোভাবে নির্বাচন করে ফেলা—ক্ষমতাসীনদের এমন অবস্থানকেও বিএনপি নেতাদের অনেকে ‘চাপ’ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, একতরফাভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হলে সরকার বিএনপির ব্যাপারে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠোর হবে। তখন দল হিসেবে বিএনপি অস্তিত্বের সংকটে পড়বে এবং সারা দেশে নেতা-কর্মীদের ওপর দমনপীড়নের মাত্রা বেড়ে যাবে।
যেকোনো মূল্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের লক্ষ্য আওয়ামী লীগের। এর কোনো বিকল্প চিন্তা মাথাতেই আনতে রাজি নন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের আচরণ এবং নিজ দলের ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর চাপ—সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে চাইছেন। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাও তাঁদের জন্য সহায়ক হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
পিছপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই—এমন চিন্তা থেকে বিএনপি এবার চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি নিতে চাইছে। ১৮ অক্টোবর (আজ বুধবার) দলটির আন্দোলনের চলমান ধাপের কর্মসূচি শেষ হচ্ছে। এ মাসের শেষেই কঠোর কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে দলটি। বিএনপির নেতারা বলছেন, কঠোর পরিস্থিতির মুখেও রাজপথে থাকবেন তাঁরা। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের দিক থেকে কোনো ঘোষণা ছাড়া তাঁরা সংলাপেও যাবেন না।
নানামুখী চাপ থাকলেও লক্ষ্যে অটল আওয়ামী লীগও
যেকোনো মূল্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের লক্ষ্য আওয়ামী লীগের। এর কোনো বিকল্প চিন্তা মাথাতেই আনতে রাজি নন দলটির নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা মনে করেন, বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলার পাশাপাশি সময়মতো নির্বাচন করতে না পারলে কারও জন্যই পরিণতি সুখকর হবে না।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করছেন, এবার লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে না। দায়িত্বশীল কারও কারও মনে পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কাও আছে। তাঁরা মনে করছেন, এখন থেকে ভোট পর্যন্ত প্রতিদিনই বিএনপিসহ বিরোধী দল পরীক্ষায় ফেলতে পারে তাঁদের। এর সঙ্গে নতুন করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ভয়ও আছে।
সরকারের একগুঁয়েমির কারণেই পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে রাজপথে বিএনপি-জামায়াতের চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু সেভাবে আন্তর্জাতিক চাপ ছিল না। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সরকার তখন মাত্র পাঁচ বছরের শাসনকাল শেষ করেছে। এবার টানা ১৫ বছরের শাসনকালের অর্জন-ব্যর্থতা, চাপ মাথায় নিয়ে ভোটে যেতে হচ্ছে। ফলে বলা যায়, এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।
দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে আওয়ামী লীগ সেরা সময় পার করে এসেছে। এখন সামনে যত সময় আসবে, ততই সংকট-সমস্যা বাড়বে। এটা বিবেচনায় নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, পেছনে ফেরার খুব একটা জায়গা নেই।
নিষেধাজ্ঞার মুখে মনোবল ঠিক রাখা
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা এখন দলের নেতা-কর্মীদের এটা বোঝাতে চাইছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির প্রয়োগ ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের তৎপরতা ফল দেয়নি। তাই ভিসা নীতি নিয়ে চিন্তার তেমন কিছু নেই। সভা-সমাবেশের বক্তৃতায় নেতারা বিষয়টি বারবার বলার চেষ্টা করছেন। এটি কর্মীদের চাঙা রাখা এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আশ্বস্ত করার কৌশল।
তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা বা চাপ এলে ‘পাত্তা দিচ্ছি না’ বলে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই রাজপথের দখল ধরে রাখতে বিরোধীদের কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে যথাসময়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে।
পরিস্থিতি যা-ই হোক, বিরোধী দলের দাবির ব্যাপারে একচুলও ছাড় দিতে চায় না আওয়ামী লীগ এবং সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো সংলাপ বা আলোচনাতেও রাজি নয় দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ঢাকা সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল অর্থবহ সংলাপসহ যে পাঁচটি সুপারিশ করেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে সমাধানের চিন্তা করলে দুই পক্ষেরই মুখ রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান না হলে সংকট আরও গভীর হতে পারে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো রওনক জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইলে সংলাপ বা আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে অতীতে বড় বড় বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের নজির নেই। এর মানে এই নয় যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’