যেখানে বাড়ির দরজা, দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটিতেও প্রার্থীদের পোস্টার

আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দেয়ালে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার। গতকাল রাজধানীর লালবাগেশুভ্র কান্তি দাশ

মানুষের বাসাবাড়ির দরজা, দেয়াল, সরকারি স্থাপনা, দোকানের সাঁটার, বিদ্যুতের খুঁটি—কোনো কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি। ঢাকা-৭ সংসদীয় আসনের দুই প্রার্থীর পক্ষে যেখানে খুশি সেখানেই পোস্টার লাগানো হয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি বলে যে কিছু একটা আছে, সেটি পুরান ঢাকার এই নির্বাচনী এলাকায় ঢুকলে বোঝার উপায় নেই।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় ভবন, দেয়াল, গাছ, বেড়া, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি বা অন্য কোনো দণ্ডায়মান বস্তুতে পোস্টার লাগানো নিষেধ। সরকারি স্থাপনাতেও পোস্টার লাগানো নিষেধ। তবে পুরান ঢাকার লালবাগ, নবাবগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় গেলে এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যে কারও কাছে কাগুজে দলিল বলেই মনে হবে। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আহমেদের (মিলন) পক্ষে পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানা হয়নি। অনেক এলাকায় সাদাকালো পোস্টারের ক্ষেত্রে আকার মানা হয়নি। আবার বিধি ভেঙে রঙিন পোস্টারও লাগানো হয়েছে।

কেবল পোস্টারের ক্ষেত্রেই যে আচরণবিধি ভঙ্গ করা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বানানো হয়েছে তোরণ। সড়কে জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছে নির্বাচনী ক্যাম্প (কার্যালয়)। এমনকি বিধি না মেনে মোটর শোভাযাত্রা করে প্রচার চালিয়েছেন নৌকার প্রার্থী।

মঙ্গলবার শত শত মোটরসাইকেল, অন্তত ৬০টি লেগুনা, ২৫টি পিকআপ (ছোট ট্রাক), ২৬টি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে মহড়া দেওয়া হয়। এতে বর্তমান সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম উপস্থিত ছিলেন। বহরে থাকা ছাদখোলা একটি গাড়ি থেকে তিনি মানুষের মধ্যে চকলেট বিতরণ করেন।
রাস্তার ওপর তৈরি করা হয়েছে নির্বাচনী ক্যাম্প। গতকাল পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা-৭ সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আচরণবিধি ভঙ্গের এমন চিত্র দেখা গেছে। প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক ও একজন আলোকচিত্রী মোটরসাইকেলে করে এই আসনের তিনটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়ক ও এলাকা ঘুরে দেখেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১৩টি ওয়ার্ড নিয়ে এই আসন গঠিত। ওয়ার্ডগুলো হলো ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৫ ও ৩৬। এই আসনের ভোটার প্রায় সাড়ে ৩ লাখ।

আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম। তিনি এবার নির্বাচন করছেন না। তাঁর ছেলে সোলায়মান সেলিম এবার নৌকার প্রার্থী। সোলায়মানসহ মোট সাতজন এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বাকিরা হলেন জাতীয় পার্টির সাইফুদ্দিন আহমেদ (লাঙ্গল প্রতীক), জাসদের হাজি মো. ইদ্রিস বেপারী (মশাল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের নুরজাহান বেগম (ছড়ি), বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির মোহাম্মদ আফসার আলী (একতারা), এনপিপির মাসুদ পাশা (আম) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হাসিবুর রহমান (ঈগল)। হাসিবুর ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের (লালবাগ এলাকা) বর্তমান কাউন্সিলর।

আরও পড়ুন

ঘোষণা দিয়ে বিধি ভাঙেন নৌকার প্রার্থী

সোলায়মানের প্রচার মানেই আচরণবিধি লঙ্ঘন—এটি যেন দিন দিন রীতি হয়ে উঠছে। গত মঙ্গলবার তাঁর পক্ষে প্রচারের যে চিঠি সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো হয়, তাতে উল্লেখ ছিল পিকআপ, সাউন্ড সিস্টেম, ঘোড়ার গাড়ি, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহকারে উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচার চালানো হবে। যদিও আচরণবিধি অনুযায়ী, মোটরসাইকেল, বাস-ট্রাকসহ যান্ত্রিক যানবাহন নিয়ে মিছিল বা শোডাউন (মহড়া) করার সুযোগ নেই।

মঙ্গলবার শত শত মোটরসাইকেল, অন্তত ৬০টি লেগুনা, ২৫টি পিকআপ (ছোট ট্রাক), ২৬টি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে মহড়া দেওয়া হয়। এতে বর্তমান সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম উপস্থিত ছিলেন। বহরে থাকা ছাদখোলা একটি গাড়ি থেকে তিনি মানুষের মধ্যে চকলেট বিতরণ করেন। সেদিন গাড়িবহর নিয়ে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী এলাকার পলাশী মোড়, আজিমপুর, নবাবগঞ্জ বাজার, লালবাগ কেল্লা, মদিনা টাওয়ার, ডালপট্টি, চকবাজার, ইমামগঞ্জ, মিটফোর্ড, বাবুবাজার ও ইসলামপুর এলাকায় প্রচার চালানো হয়। এতে এসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।

আচরণবিধি ভঙ্গ করে পোস্টার লাগানো ও নির্বাচনী প্রচারের বিষয়ে জানতে নৌকার প্রার্থী সোলায়মান সেলিমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়ে বক্তব্য জানতে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

গতকাল দুপুরে নবাবগঞ্জ বড় জামে মসজিদের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপর নৌকার প্রার্থীর বাবা সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিমের পক্ষে একটি ব্যানার টাঙানো। এতে লেখা ‘হাজি মো. সেলিম নবাবগঞ্জ বড় জামে মসজিদে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করবেন এবং ছানা-মাঠা খাওয়াবেন’।

নিয়ম না মেনে প্রার্থীদের ভোটের প্রচারের বিষয়ে লালবাগ এলাকার দুজন দোকানি নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকার ভোটে কেউ নিয়ম মানতে চায় না। যে যার মতো প্রচার চালায়। এখানে নিয়ম বলে আসলে কিছু নেই। সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ে কথা বলে ঝামেলায় পড়তে চায় না। যাদের এসব দেখার কথা, তারাও ঠিকমতো দেখে না।

আমরাও প্রতিনিয়ত এসব অভিযোগ পাচ্ছি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বিধি ভঙ্গ করে লাগানো পোস্টার অপসারণ করছি। কীভাবে লাগাম টেনে ধরা যায়, সে বিষয়গুলো আরও কঠোরভাবে দেখা হবে।
ঢাকা-৭ সংসদীয় আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আতাহার মিয়া

যত্রতত্র পোস্টার

পোস্টার ও ব্যানারের আকার কেমন হবে, তা নির্বাচনী আচরণবিধিতে উল্লেখ আছে। সাদাকালো পোস্টারের আকার হবে দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৪৫ সেন্টিমিটার। সাদাকালো ব্যানারের আকার হবে দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ তিন মিটার ও প্রস্থে এক মিটার। এ ছাড়া ব্যানার ও পোস্টারে প্রার্থীর প্রতীক ও নিজের ছবি ছাড়া অন্য কারও ছবি না দেওয়ার নির্দেশনা আছে আচরণবিধিতে। তবে প্রার্থী কোনো রাজনৈতিক দল মনোনীত হলে সে ক্ষেত্রে দলীয় প্রধানের ছবি পোস্টারে দেওয়া যাবে।

কিন্তু ঢাকা-৭ আসনে এসব নির্দেশনার একটিও মানছেন না নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থীরা। বেঁধে দেওয়া আকারের চেয়ে বেশ বড় পোস্টার ও ব্যানার দেখা গেছে দুই প্রার্থীর। দুই প্রার্থীর পক্ষে লাগানো পোস্টারে ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিয়ম মানা হয়নি। এই আসনের আওতাধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় প্রতিটি সড়কের পাশের দেয়ালে পোস্টার লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে পুরাতন পলাশীতে রাস্তার পাশের দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। আজিমপুরে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের সামনের দেয়ালে নৌকা, লাঙ্গল ও ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর পোস্টার রয়েছে।

এই আসনের বিষ্ণু চন্দ্র দাস স্ট্রিট, শেখ সাহেব বাজার রোড, সুবল দাস রোড, নবাবগঞ্জ রোড, নবাবগঞ্জের হোসেন উদ্দিন খান প্রথম লেন, জে এন সাহা রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশের ভবন, দোকান, বিদ্যুতের খুঁটিতে নৌকা, লাঙ্গল ও ঈগল প্রতীকের পোস্টার দেখা গেছে। এমনকি লালবাগ থানা কার্যালয়ের দেয়ালেও লাঙ্গল ও নৌকার পোস্টার রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৌকার পোস্টারের ওপর লাঙ্গলের পোস্টার লাগানো হয়েছে।

ভোট চেয়ে তৈরি করা হয়েছে তোরণ। সাঁটানো হয়েছে ডিজিটাল বড় ব্যানার।
ছবি: প্রথম আলো

আচরণবিধি ভেঙে দেয়ালে পোস্টার লাগানোর বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদের মুঠোফোনে কল করা হলে কথা বলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী রাহাল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁদের প্রার্থী গণসংযোগে আছেন, এখন তিনি কথা বলতে পারবেন না।

একই প্রশ্ন করা হয়েছিল ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমানকে। তিনি বলেন, ‘সব পোস্টার তো নৌকা আর লাঙ্গলের। আমি যে পোস্টার লাগাব, সে জায়গাও নাই। কিছু জায়গায় নেতা-কর্মীরা না বুঝে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে দিয়েছে।’
এই নির্বাচনী এলাকায় রাস্তা ও ফুটপাতের জায়গা দখল করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে সড়কের ওপর নৌকার পক্ষে দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, একটি ওয়ার্ডে একটির বেশি ক্যাম্প যেমন করার সুযোগ নেই, তেমনি মানুষের চলাচলে সমস্যা করে ফুটপাত ও সড়কের জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করা যায় না।

মাইকিং করার ক্ষেত্রে এখানে আচরণবিধি মানা হচ্ছে না। বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মাইকিং করার নির্দেশনা থাকলেও গতকাল দুপুর ১২টার দিকে লালবাগ এলাকার নৌকার প্রার্থীর পক্ষে মাইকিং করতে দেখা গেছে।

নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থী আচরণবিধি বেশি ভাঙছেন, এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে ঢাকা-৭ সংসদীয় আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আতাহার মিয়া গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও প্রতিনিয়ত এসব অভিযোগ পাচ্ছি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বিধি ভঙ্গ করে লাগানো পোস্টার অপসারণ করছি। কীভাবে লাগাম টেনে ধরা যায়, সে বিষয়গুলো আরও কঠোরভাবে দেখা হবে।’