রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবি: সাংবিধানিক সংকট চায় না বিএনপিসহ বিভিন্ন দল 

১২-দলীয় জোট ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব। সেখানে তিনি রাষ্ট্রপতি অপসারণ প্রশ্নে দলের অবস্থান তুলে ধরেনছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের প্রশ্নে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি আরও একবার শক্তভাবে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। গতকাল রোববার দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়ায় গতকাল ১২-দলীয় জোট ও গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল এসব রাজনৈতিক দল।

আরও পড়ুন

 গতকাল বিকেলে মালিবাগে ১২-দলীয় জোটের একটি দলের কার্যালয়ে এ বৈঠকে জোটটি রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রশ্নে বিএনপির বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছে। তারাও রাষ্ট্রপতির পদে শূন্যতা এনে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির পক্ষে নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকের পর ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে এবং নির্বাচন বিলম্বিত হবে। সেটি তাঁরা চান না। তাঁরা তাঁদের এই অবস্থান বৈঠকে জানিয়েছেন।

গণ-অভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তোলার জন্য বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তাহলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম, মহাসচিব, বিএনপি 

তবে শাহাদাত হোসেন এ-ও জানান, রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা সমাবেশসহ আন্দোলনের কর্মসূচি নেবেন বলেও তাঁদের জানিয়েছেন। বিএনপিসহ সব দল যদি বিষয়টিতে একমত হয়, তখন তাঁরাও তা বিবেচনা করবেন।

আরও পড়ুন

গণ অধিকার পরিষদও এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে নয়। তারা ভিন্ন ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে। দলটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করে তারপর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও নতুন সংবিধান প্রণয়নসহ অন্যান্য বিষয়ে সমাধানের কথা বলেছে। গতকাল সন্ধ্যায় দলটির নেতাদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। 

শাহাদাত হোসেন এ-ও জানান, রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা সমাবেশসহ আন্দোলনের কর্মসূচি নেবেন বলেও তাঁদের জানিয়েছেন। বিএনপিসহ সব দল যদি বিষয়টিতে একমত হয়, তখন তাঁরাও তা বিবেচনা করবেন।

বৈঠকের পর গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়সহ আরও অনেক সংকট সামনে আসতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখন পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না। সে জন্য এখন রাষ্ট্রপতির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে নন তাঁরা। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি ও অংশীজনদের নিয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করে রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। এই অবস্থান তাঁরা বৈঠকে তুলে ধরেছেন।

এ নিয়ে চার দিন ধরে চারটি দল ও একটি জোটের সঙ্গে বৈঠক করল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। এসব দলের মধ্যে শুধু জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে ছাত্রনেতাদের দাবির পক্ষে মত দিয়েছে। বিএনপিসহ অন্য দলগুলো রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের প্রতি সহানুভূতি না থাকার কথা বলছে। কিন্তু তারা এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পক্ষে নয়।

১২-দলীয় জোট ও গণ অধিকার পরিষদ আমাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায়। তবে রাষ্ট্রপতির অপসারণ কী প্রক্রিয়ায় হতে পারে ও পরে কে আসতে পারেন, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট আলোচনা চেয়েছে ১২-দলীয় জোট। গণ অধিকার পরিষদ বলেছে, সব রাজনৈতিক দল মিলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ভালো হয়
আরিফুল ইসলাম

কেন হঠকারী পদক্ষেপ বলছে বিএনপি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা গত শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর আগে বৃহস্পতিবারও তাঁরা বিএনপির তিন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। শনিবারের বৈঠকে বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ ছাত্রনেতাদের অন্যান্য দাবি নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। 

তবে গতকাল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারকে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তাহলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। তার জন্য বেশি প্রয়োজন অতি দ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার শেষে নির্বাচন করা।’

গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল।

এ নিয়ে চার দিন ধরে চারটি দল ও একটি জোটের সঙ্গে বৈঠক করল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। এসব দলের মধ্যে শুধু জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে ছাত্রনেতাদের দাবির পক্ষে মত দিয়েছে।

এর আগে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের তিন নেতা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য করে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না করার কথা বলেছেন।

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাপত্র) ঘোষণাসহ যেসব দাবি তোলা হয়েছে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দলটিতে। এমন দাবি তোলার পেছনে আরও কেউ আছে কি না এবং লক্ষ্যই বা কী, বিএনপির নেতারা এসব বিষয় পর্যালোচনা করার চেষ্টা করছেন।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে। সে জন্য তাঁরা সার্বিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোর বেশির ভাগই একই অবস্থান তুলে ধরছে। 

গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে বৈঠকে ১২-দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার, শাহাদাত হোসেন, অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, সৈয়দ এহ্সানুল হুদা, মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, মো. ফারুক রহমান, শামসুদ্দিন পারভেজ ও এ এস এম শামীম।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে। সে জন্য তাঁরা সার্বিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

পৃথক বৈঠকে গণ অধিকার পরিষদের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলটির সভাপতি নুরুল হক, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, উচ্চতর পরিষদ সদস্য শহিদুল ইসলাম ফাহিম, আবু হানিফ, ফাতেমা তাসনিম, শাকিল উজ্জমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মামুন, আইনবিষয়ক সহসম্পাদক হাবিবুর রহমান ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন। 

দুটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সাতজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সদস্যসচিব আরিফ সোহেল, মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার সেক্রেটারি আরিফুল ইসলাম।

দুটি বৈঠকেই অংশ নেওয়া আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১২-দলীয় জোট ও গণ অধিকার পরিষদ আমাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায়। তবে রাষ্ট্রপতির অপসারণ কী প্রক্রিয়ায় হতে পারে ও পরে কে আসতে পারেন, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট আলোচনা চেয়েছে ১২-দলীয় জোট। গণ অধিকার পরিষদ বলেছে, সব রাজনৈতিক দল মিলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ভালো হয়।’