চট্টগ্রাম বিএনপির শীর্ষ ছয় নেতা ৫০৬ মামলার আসামি
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা এখন ৮৮। পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধাদান, ভাঙচুর ও নাশকতার অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার নগরের কাজীর দেউড়ি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় হওয়া নতুন চারটি মামলায়ও তাঁকে আসামি করা হয়।
শাহাদাত হোসেন জানান, এসব মামলায় মাসে ২২ থেকে ২৩ দিন হাজিরা দিতে হয় আদালতে। সর্বশেষ ৫০ দিন কারাভোগের পর ২০২১ সালের মে মাসে জামিনে মুক্তি পান তিনি। এখন নতুন মামলায় ফের গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন পেশায় চিকিৎসক এই বিএনপি নেতা।
শাহাদাতের পাশাপাশি নগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেমেরও নতুন ৪টিসহ ৬৬টি মামলা রয়েছে। তবে তাঁদের চেয়েও মামলা বেশি নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী সিরাজ উল্লাহর—১৩৪টি।
রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে শাহাদাতসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়েছে। যেসব মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ, সেগুলোতে কোনো তদন্ত ছাড়াই পুরো এজাহার তুলে দেওয়া হয়েছে।কামরুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপি নেতা-কর্মীদের মামলা পরিচালনাকারীদের একজন আইনজীবী
তারপর রয়েছেন নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তজা খান—১১০টি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ৪১টি ও নগরের খুলশী থানা বিএনপির সভাপতি আবদুল হালিম ৬৭টি মামলার আসামি। এই ছয় নেতার বিরুদ্ধে গত সোমবার পর্যন্ত মামলার সংখ্যা দাঁড়াল ৫০৬টি। বিভিন্ন সময় তাঁরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন। এখন সবাই জামিনে আছেন। তবে নতুন করা চার মামলায় আবারও গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন তাঁরা। ৪টি মামলায় নাম উল্লিখিত ২৫৮ আসামির মধ্যে আছেন তাঁরাও।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, ২০১০ সাল থেকে সর্বশেষ গত সোমবার পর্যন্ত বিএনপির নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৪টি। এতে আসামি করা হয় প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার নেতা-কর্মীকে। প্রায় প্রতিটি মামলার ধরন একই—পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, গাড়ি ভাঙচুর ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে করা ‘গায়েবি’ মামলাও রয়েছে।
গত সোমবার করা নতুন ৪টি ও ২০২১ সালের ২৯ মার্চ মোদিবিরোধী বিক্ষোভে হেফাজত-পুলিশ সংঘর্ষের প্রতিবাদে বিএনপি ঘোষিত নগর বিএনপির কার্যালয়ের সামনের কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় করা মামলাটি ছাড়া বাকি সব মামলায় তদন্ত শেষ করেছে পুলিশ। এর মধ্যে কোনোটি বিচার শুরুর অপেক্ষায়, আবার কোনোটির সাক্ষ্য চলছে।
কর্মীদের সহিংসতার দায়ভার নেতারা এড়াতে পারেন না। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে অনুমতি দিয়েছে। এরপরও তারা সহিংসতার দিকে যাচ্ছে।আ জ ম নাছির উদ্দীন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলা ও গ্রেপ্তার নিয়ে শঙ্কিত নন নেতা-কর্মীরা। কারাগার ও হাজিরা জীবনের অংশ হয়ে গেছে। জ্বালাও পোড়াও নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী বিএনপি; বরং তারা (আওয়ামী লীগ) নিজেরাই করে জ্বালাও–পোড়াও বিএনপিকে দোষারোপ করে আসছে।
দলীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিএনপির প্রথম সারির নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীর বেশির ভাগই নাশকতার অভিযোগে পুলিশের করা মামলার আসামি। ৭টি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৩৪টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে একেকজনের বিরুদ্ধে। মাসের অর্ধেক সময় কেটে যায় আদালতে মামলার হাজিরায়।
বিএনপি নেতা-কর্মীদের মামলা পরিচালনাকারীদের একজন আইনজীবী কামরুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে শাহাদাতসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়েছে। যেসব মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ, সেগুলোতে কোনো তদন্ত ছাড়াই পুরো এজাহার তুলে দেওয়া হয়েছে।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, নগরের কাজীর দেউড়িতে গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার দৃশ্য সবাই দেখেছে। নাশকতার আগের মামলাগুলোর ঘটনাও একই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেনি। যেগুলোর বিচার চলছে, সেগুলোতে রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধ প্রমাণিত করবে।
চট্টগ্রামের সম্পাদক । তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিএনপিসহ সব দলকে সমানভাবে সমাবেশ করতে দিতে হবে। কিছু কর্মী উচ্ছৃঙ্খলতা করলে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা নেবে।আখতার কবির চৌধুরী, নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক
চট্টগ্রামে বিএনপি কার্যক্রম পরিচালিত হয় কাজীর দেউড়ি এলাকার নাসিমন ভবন থেকে। ভবনটিতে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির কার্যালয়। গত ১২ অক্টোবর নগরের পলোগ্রাউন্ডে সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপির দ্বিতীয় ধাপের আন্দোলন কর্মসূচির শুরু হয়। সমাবেশের পর থেকে চাঙা হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম বিএনপি। বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাড়তে থাকে নেতা–কর্মীর উপস্থিতি। দলীয় কার্যালয়ের সামনের মাঠ পূর্ণ হয়ে পাশের সড়কে উপস্থিতি থাকে নেতা-কর্মীদের। তবে নতুন মামলা হওয়ায় আতঙ্কের কারণে উপস্থিতি কমতে পারে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, দলের প্রতিটি সভায় যে হারে লোকজনের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তাতে নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রাখতে নতুন করে মামলা দেওয়া হয়েছে। একই মন্তব্য উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারের।
চট্টগ্রামে বিএনপির শীর্ষ নেতারা একের পর এক মামলার আসামি হওয়া প্রসঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, কর্মীদের সহিংসতার দায়ভার নেতারা এড়াতে পারেন না। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে অনুমতি দিয়েছে। এরপরও তারা সহিংসতার দিকে যাচ্ছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ মামলা করেছে। আদালতে বিচার হবে। অপরাধী কি না, আদালত নির্ধারণ করবেন।
নতুন মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্ক
গত সোমবার কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশে আসা মিছিলে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ ২৫৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয়ের ১ হাজার ৩০০ জনকে আসামি করে পুলিশ নতুন করে চারটি মামলা করেছে। ঘটনাস্থল থেকে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে গতকাল মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলার পরপর সোমবার রাতভর নগর বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেন, আবুল হাশেমসহ প্রায় অর্ধশত নেতা-কর্মীর বাসায় গ্রেপ্তার অভিযান চালায় পুলিশ। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এটি অব্যাহত থাকবে বলে জানান কোতোয়ালি থানার ওসি জাহিদুল কবির। তিনি বলেন, পুলিশের ওপর হামলা ও রাস্তায় থাকা গাড়ি ভাঙচুর করে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পুলিশ বাধা দেয়নি। উল্টো তারাই পুলিশের ওপর চড়াও হন।
রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সভা–সমাবেশ করবেন, এটি দেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিএনপিসহ সব দলকে সমানভাবে সমাবেশ করতে দিতে হবে। কিছু কর্মী উচ্ছৃঙ্খলতা করলে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা নেবে। ইতিপূর্বে গায়েবি মামলায় মৃত ব্যক্তিকে পুলিশকে আসামি করতে দেখা গেছে। সমাবেশে বাধা দেওয়া, ঢালাওভাবে সব নেতা-কর্মীকে মামলায় জড়ানো উচিত নয়।