গায়েবি, পুরোনো ‘নাশকতা’ আর নতুন মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতারা, হচ্ছে সাজা
‘গায়েবি’ মামলায় দ্রুত সাজা দিতে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে, অভিযোগ বিএনপির। অস্বীকার করছে আইন মন্ত্রণালয়।
‘গায়েবি’ মামলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সাজার তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। সেই সঙ্গে পুরোনো ‘নাশকতার’ মামলায় নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। যার সর্বশেষ শিকার বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী (এ্যানী)। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ধানমন্ডি থানার পুলিশ তাঁকে নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে।
এদিকে আবার নতুন করে মামলা দেওয়াও শুরু হয়েছে। গত পাঁচ দিনে যশোর, কুষ্টিয়া, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে ১৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির ৩২৩ জন সক্রিয় নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে বলে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
এর মধ্যে যশোরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ১১টি মামলা করেছে। এসব মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের ৭৭ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এসব মামলাকে গায়েবি মামলা বলে উল্লেখ করছে বিএনপি।
বিএনপির নেতারা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ‘নাশকতার’ অভিযোগে পুরোনো মামলায় বিএনপির নেতাদের সাজার ঘটনা বাড়ছে। গত ছয় মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ ৯৬ জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।
বিএনপি নির্বাচনে গেলে তাঁদের অনেকে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এলাকায় ও দলে আলোচনায় রয়েছেন। মূলত সম্ভাব্য প্রার্থী, গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের লক্ষ্য করে গ্রেপ্তার ও সাজার ঘটনাগুলো ঘটছে।
শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে যদি ওয়ারেন্ট বা সুস্পষ্ট মামলা থাকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজই হলো ওই সকল লোকদের গ্রেপ্তার করা। সে যে পর্যায়ের নেতাই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না।’
‘গায়েবি’ মামলায় দ্রুত সাজা দিতে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে, যাদের কাজ হলো বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও গায়েবি মামলার তালিকা করে দ্রুত বিচার করে সাজা দিতে আদালতকে নির্দেশ দেওয়া।
দরজা ভেঙে গ্রেপ্তারের নিন্দা
মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার শহীদ উদ্দীন চৌধুরী লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের দুবার সংসদ সদস্য ছিলেন। আগামী নির্বাচনেও সম্ভাব্য প্রার্থী। তাঁকে গভীর রাতে পুলিশ বাসার দরজা ভেঙে গ্রেপ্তার করে। প্রায় সাড়ে চার মাস আগের ধানমন্ডি থানায় নাশকতার অভিযোগের একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত তাঁকে চার দিনের রিমান্ড দেন। রিমান্ডের শুনানি চলাকালে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী আদালতের কাছে অভিযোগ করেন, বাসার দরজা ভেঙে গ্রেপ্তারের পর থানায় নিয়ে তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয়। এ সময় পুলিশের নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে শহীদ উদ্দীন আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন এবং কেঁদে ফেলেন।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে দরজা ভেঙে গ্রেপ্তারের ঘটনার নিন্দা জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘ডাকাত যেভাবে দরজা ভেঙে বাসায় ঢোকে, ঠিক সেভাবে ঢুকেই শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সরকার আগের মতোই একতরফা নির্বাচন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের দলের সম্ভাব্য নেতাদের আটক করা শুরু করেছে। অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজাও দিয়েছে।’
শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের দুই-তিন দিন আগে পুরোনো মামলায় বিএনপির ২৪ জন নেতার বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এর মধ্যে ৯ অক্টোবর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ১৫ জনকে ৪ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সাজাপ্রাপ্তদের ১৪ জনই বিএনপির নেতা-কর্মী। ১ জন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব আহসান হাবীব লিংকন। ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে পুলিশের এক মামলায় তাঁদের এ সাজা হয়।
তার আগের দিন ৮ অক্টোবর ১১ বছর আগের পুরোনো মামলায় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজোয়ানুল হকসহ ১০ জনের দুই বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের পৃথক মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদের ৯ বছর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান ও তাঁর স্ত্রীর ১৩ বছরের সাজার রায় হয়। সে মামলায় আমান এখন জেলে, ইকবাল হাসান মাহমুদ বিদেশে আছেন।
ডাকাত যেভাবে দরজা ভেঙে বাসায় ঢোকে, ঠিক সেভাবে ঢুকেই শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সরকার আগের মতোই একতরফা নির্বাচন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের দলের সম্ভাব্য নেতাদের আটক করা শুরু করেছে। অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজাও দিয়েছে
এ ছাড়া গত ৭ আগস্ট গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে ১০ বছর আগের মামলায় যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক আলী সরকারসহ ২১ জনকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০২ সালে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার দুই মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৪ জনকে যাবজ্জীবন ও অন্য ৪৪ জন আসামিকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
‘গায়েবি’ মামলায় দ্রুত সাজা দিতে আইন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ শাখা খোলা হয়েছে, যাদের কাজ হলো বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও গায়েবি মামলার তালিকা করে দ্রুত বিচার করে সাজা দিতে আদালতকে নির্দেশ দেওয়া।
বিএনপি নেতার এই অভিযোগ সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির মহাসচিব নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে কথা বলবেন বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।
একই সঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, মামলার জট কমানোর জন্য সরকারি আইন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে ১০ বছর আগে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছিল। সেই সেলই বহাল রয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মামলার ব্যাপারে কোনো সেল নেই বলে তিনি দাবি করেন। তবে বিএনপি নেতারা আবার এমন বক্তব্য মানতে রাজি নন।