হঠাৎ রদবদলে তোলপাড় বিএনপিতে
ঢাকাসহ চার মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটিতেও বড় রদবদল করল বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, একই প্রক্রিয়ায় দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক স্তরে পরিবর্তন আসছে। তবে হঠাৎ এভাবে কমিটি ভাঙাগড়ায় নেতাদের অনেকে হতাশ।
দলের নেতা-কর্মীরা যখন ঈদুল আজহা উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিএনপিসহ দলের যুব ও ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এবং যুবদলে রদবদল করা হলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক ক্ষমতাবলে এই রদবদল করেন। এ বিষয়ে কিছুদিন ধরে এ তৎপরতা আঁচ করা গেলেও নীতিনির্ধারণী নেতারা জানতেন না। এতে অনেকে বিরক্ত। তবে এ বিষয়ে তাঁরা কথা বলতে রাজি নন।
ভালো-খারাপ কিছুই বলব না। যত দিন বেঁচে আছি, বিএনপির কর্মী হিসেবে কাজ করে যাব।সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, সদ্য সাবেক যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি
দলটির নেতারা এই ওলট–পালটে কার্যত বিএনপির পরবর্তী কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রাক্–প্রস্তুতির ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। তাঁদের ধারণা, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে আরও রদবদলের পর দলের শীর্ষ নেতৃত্ব একটি ‘পরিকল্পিত’ সম্মেলন অনুষ্ঠানের দিকে যেতে পারেন। কারণ, রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন রক্ষায় সম্মেলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সর্বশেষ বিএনপির জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল আট বছর আগে ২০১৬ সালের মার্চ। যদিও দলের গঠনতন্ত্রে তিন বছর পরপর সম্মেলন করার বিধান রয়েছে। এখন সম্মেলন না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কমিটিতে এই রদবদল আনা হলো।
গতকালের রদবদলে পদোন্নতি পাওয়া তিন যুগ্ম মহাসচিবের একজন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আরও পুনর্গঠন হবে, এই পুনর্গঠন সাময়িক। এরপর হয়তো কাউন্সিল হবে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিএনপির ঢাকার দুটিসহ (উত্তর ও দক্ষিণ), চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। একই সময় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকার চার আঞ্চলিক কমিটি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে বিএনপি ও যুবদলে এই ওলট–পালটের মধ্যে গতকাল শনিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের (আংশিক পূর্ণাঙ্গ) কমিটির ঘোষণা আসে।
বেশি আলোচনা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ৪৪টি পদে রদবদল এবং ২৯ সদস্যের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে। নির্বাহী কমিটিতে ৩৩ পদে নেতাদের কাউকে কাউকে নতুন যুক্ত করা হয়েছে, আবার কারও কারও পদ পরিবর্তন করা হয়েছে। এই রদবদলে উপদেষ্টা পরিষদে ১১ জনকে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জহির উদ্দিন স্বপন ও মেজর জেনারেল (অব.) মো. শরীফ উদ্দীন।
এই রদবদল নিয়ে সদ্য নিযুক্ত বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের সমর্থন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের নৈতিক সমর্থন কাজে লাগানোর লক্ষ্য নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই লক্ষ্যে দল পুনর্গঠনে হাত দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এই রদবদলে যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হয়েছে মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, হারুন অর রশীদ ও আসলাম চৌধুরীকে (বর্তমানে জেলে)। এ ছাড়া রুহুল কুদ্দুস তালুকদার, সাখাওয়াত হাসান, বেবী নাজনীন ও খালেদ হোসেন চৌধুরীকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। আবার দুই সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ ও আবদুস সালাম আজাদকে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়েছে আসাদুজ্জামান রিপনকে।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ কয়েকজন নেতাকে যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পদে পদায়ন করা হয়েছে। তাঁদের ওপর তারেক রহমান সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিভিন্ন কারণে কিছু নেতার ওপর মনঃক্ষুণ্ন। এ কারণে তাঁদের সাংগঠনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন।
সদ্য সাবেক এই যুগ্ম মহাসচিব গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভালো-খারাপ কিছুই বলব না। যত দিন বেঁচে আছি, বিএনপির কর্মী হিসেবে কাজ করে যাব।’
সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদেও রদবদল
কাজী সাইয়েদুল আলম সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ), সৈয়দ শাহীন শওকত খালেক সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ), জি কে গউছ সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ), শরিফুল আলম সাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ বিভাগ), সুলতান সালাউদ্দিন প্রচার সম্পাদক, মোর্শেদ হাসান খান গণশিক্ষা সম্পাদক, শামীমুর রহমান গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক, আমিরুল ইসলাম খান সহসাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগ), নজরুল ইসলাম আজাদ সহসাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ), আমিনুল ইসলাম সহসাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ), মীর হেলাল উদ্দিন সহসাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ), আবু ওয়াহাব আকন্দ সহসাংগঠনিক সম্পাদক (ময়মনসিংহ বিভাগ)। মিফতাহ সিদ্দিকী সহসাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগ), নাহিদ খান সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, মো. নজরুল ইসলাম সহ স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক, এস এম সাইফ আলী সহ–তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আবদুস সালাম আজাদসহ কাউকে কাউকে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। গাজীপুর জেলা বিএনপির সম্মেলনে কাজী সাইয়েদুল আলম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করে ভোটে হারেন। কয়েক মাস আগে তাঁকে সহসাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেওয়া হয়। এবার তাঁকে সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) করা হলো। ছাত্রদল নেতা আমীরুল ইসলাম খানকে সহসাংগঠনিক সম্পাদক করে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে সৈয়দ শাহীন শওকত খালেককে। শাহীন শওকতের বিরুদ্ধে দলের ভেতরে অনেক অভিযোগ আছে।
অন্যদিকে জালাল উদ্দিন মজুমদার, সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, সায়েদুল হক সাঈদ, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল ফারুক, এস এম গালিব—এই পাঁচজনকে সহসাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি পুনর্গঠন
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি দলের নেতা-কর্মীদের সমালোচনার মুখে পড়ে। তাঁদের দাবি, কমিটি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া বা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। তাতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় শক্তিধর দেশগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশিত ভূমিকা দেখা যায়নি। এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি পুনর্গঠন করা হলো। তারেক রহমান এই কমিটির প্রধান হলেও কার্যত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে কমিটি কাজ করবে বলে জানা গেছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আগের কমিটির প্রধান ছিলেন।
নতুন এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন নজরুল ইসলাম খান (স্থায়ী কমিটির সদস্য), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (স্থায়ী কমিটির সদস্য), আলতাফ হোসেন চৌধুরী (ভাইস চেয়ারম্যান), আবদুল আউয়াল মিন্টু (ভাইস চেয়ারম্যান), নিতাই রায় চৌধুরী (ভাইস চেয়ারম্যান), ইসমাইল জবিউল্লাহ (চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য), হুমায়ুন কবির (আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক), সিরাজুল ইসলাম (সাবেক রাষ্ট্রদূত) ও তাজভিরুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি)।
আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, দলকে শিগগিরই আন্দোলনমুখী করার পরিকল্পনা সামনে রেখে এই পুনর্গঠন করা হচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সহায়ক কমিটিও করা হয়েছে। এতে রয়েছেন শামা ওবায়েদ, অনিন্দ্য ইসলাম, নাসির উদ্দিন অসীম, নওশাদ জমির, কায়সার কামাল, আসাদুজ্জামান, আফরোজা খান, ফাহিমা নাসরিন, জিবা খান, নিপুণ রায় চৌধুরী, শেখ রবিউল আলম, মীর হেলাল উদ্দিন, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, ফারজানা শারমীন, ইসরাফিল খসরু, আবু সালেহ মো. সায়েম (ইউকে) ও ইকবাল হোসেন (বেলজিয়াম)।
গত দুই দিনে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলে এই রদবদল হয় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে। অনেকে মনে করেন, এই রদবদলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁরও একটা অংশগ্রহণ ছিল। কিছু কিছু পদে রুহুল কবির রিজভীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত নেতারা ভালো পদ পাওয়ায় এ আলোচনা আরও বেড়েছে।
অবশ্য এ বিষয়ে রহুল কবির রিজভী রদবদলে তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এ জায়গায় যিনি থাকবেন, তিনিই এ দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নেতা-কর্মী এ ধরনের কথা বলেন থাকেন, এটা সম্পূর্ণরূপে অপপ্রচার। এখানে কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই তো বিএনপিরই লোক।’