‘বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য আমেরিকাকে অনুরোধ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেটি করতে যা যা করা দরকার, তা করতে মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করেছেন তিনি। তিনি নিজেই বলেছেন যে আমেরিকায় গিয়ে তিনি বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে বলেছেন।’
ওপরে যা লিখলাম, তা কল্পিত। কিন্তু এটি যদি সত্যি হতো, কী প্রতিক্রিয়া হতো দেশে? কতগুলো রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতো মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে? আমরা সহজেই এসব অনুমান করতে পারি।
প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, এ ধরনের কথা আসলে বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি ভারতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য ‘যা যা করা দরকার’, তা-ই করার অনুরোধ করেছেন। এটি তিনি নিজেই গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম শহরে জন্মাষ্টমী উৎসবের অনুষ্ঠানে সবাইকে জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনকে তবু ধন্যবাদ। সরকার যে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তা তিনি অকপটে বলেছেন। এর নজির বা আলামতও পাওয়া গেছে অতীতে। ২০১৪ সালে অধিকাংশ দলের মতো এরশাদের জাতীয় পার্টিও যখন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল এবং একতরফা নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফর করছিলেন। এরশাদ সে সময় জানিয়েছিলেন যে ভারত তাঁকে জোর করে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করিয়েছে। সারা বিশ্বের পর্যবেক্ষকদের বর্জনের মধ্যে ভুটান ছাড়া একমাত্র ভারতই সেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল। ২০১৪ তো বটেই, আরও বিতর্কিত ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ভারত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হিসেবে সোৎসাহে সার্টিফাই করেছিল। এগুলো ভারত করেছে প্রকাশ্যে। এমন রাখঢাকহীন সমর্থন করলে আড়ালেও অনেক কিছু করার কথা। বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে সেটি করার সামর্থ্য ও সুযোগ ভারতের আছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কি একটি স্বাধীন দেশের জন্য গ্রহণযোগ্য? পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে সত্য উদোম করে দিয়েছেন, তা কি অসীম আত্মদানে দেশ স্বাধীন করা জাতির জন্য গৌরবজনক? ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রকৃতিই বা কি এই সরকারে আমলে?
২.
বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ভারতকে কিছু বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সীমান্তে এখন ভারতের অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। বছরে ২৮ লাখ মানুষ ভারতে বেড়াতে যায়। কয়েক লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করে। বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা হলেও তিনি ও সরকার নীরব থাকেন।
কিন্তু এগুলো যদি ক্ষমতায় থাকার বিনিময়মূল্য হয়, তাহলে তা কি স্বস্তিকর বাংলাদেশের জন্য?
প্রশ্ন আরও আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যমতো বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা হলে সরকার নীরব থাকবে কেন? যে সীমান্তে গুলি করে মেরে ফেলা হয় বাংলাদেশের মানুষকে, দেওয়া হয় বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বেড়া, সেখানে ভারতের অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে না—বাংলাদেশের মন্ত্রীর এ কেমন আত্মতৃপ্তি? তিনি আমাদের কী বার্তা দিচ্ছেন আসলে? ভারত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে, বিনিময়ে আওয়ামী লীগ ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে? বিষয়টি কি এমনই?
৩.
ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থনদানকারী দেশ। কিন্তু এ জন্য ভারতকে কোনো প্রভুত্ব, খবরদারি বা একচেটিয়া সুবিধা দেওয়ার জন্য শর্ত ছিল না। ভারতের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিয়ে, যৌথ নদীর ন্যায্য হিস্যা দাবি করে, পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলনে যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকার তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে ক্ষমতায় আসা ও থাকার জন্য নিরঙ্কুশভাবে জনগণের ভোটাধিকারের ওপর নির্ভর করার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি জিতেছেন মানুষের ভোটে, ভারতের সমর্থনে নয়। কোনো দিন এভাবে অন্য দেশের সমর্থন চাননি তিনি, গণপরিষদে আলোচনাকালে নির্বাচনে হারলে আনন্দের সঙ্গে বিরোধী দলকে স্বাগত জানাবেন বলেছিলেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য তাই সংবিধানবিরোধী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী। তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারতের কাছে কারিগরি বা প্রযুক্তি-সহায়তা চাইতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার জন্য বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের অবাধ হস্তক্ষেপ চাইতে পারেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম অবমাননাকরও। এটি বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকারের প্রতি চরম অস্বীকৃতিজ্ঞাপন, জনরায়ের প্রতি অবজ্ঞাসূচক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্বেগজনক। তবে আরও উদ্বেগজনক হচ্ছে এই সন্দেহ যে এটি শুধু তাঁর বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গি কি না? অনলাইনে মন্তব্য দেখলে মনে হয় অনেক মানুষ বিশ্বাস করে ক্ষমতায় থাকার উপায় হিসেবে বর্তমান সরকারের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনই ঘটিয়েছেন তিনি তাঁর বক্তব্যে।
৪.
জনাব মোমেনের বক্তব্যের পর ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটি তাঁর ব্যক্তিগত মন্তব্য। সরকারের কোনো মন্ত্রী বেফাঁস কথা বললে এ রকম আত্মরক্ষামূলক বক্তব্য জনাব কাদের আগেও দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এটা বুঝতে পারি না যে রাষ্ট্রীয় সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ভারতে গিয়ে দেশটির সরকারের কাছে তাঁর অনুরোধ ব্যক্তিগত হয় কী করে? ব্যক্তি মোমেন সেখানে গিয়ে এসব বলেননি, বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন—এই নিরেট বাস্তবতা অনুধাবনের শক্তি জনাব কাদেরের নেই—এটা কি বিশ্বাস করার মতো কিছু?
তা ছাড়া এ ধরনের কথাবার্তা নতুন বা আকস্মিক নয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য। তিনি এর আগে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো বলে অচিন্তনীয় বক্তব্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে এমন সম্পর্কের অনুমোদন নেই, সেখানে শুধু সমমর্যাদাভিত্তিক বন্ধুত্বের কথা আছে। তিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সেখানকার ভারতীয় অভিবাসীদের র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেছেন। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের আন্তরাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে অন্য দেশের নাগরিকদের ভূমিকা রাখার কোনো অবকাশ নেই। তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ভারতীয় অভিবাসীদের সমাবেশে এ কথা বলার আগে তাঁর স্মরণ রাখা উচিত ছিল, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এসব বক্তব্য ব্যক্তিগত মতামত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই; বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতামতের দায় শুধু তাঁর নয়, গোটা মন্ত্রিসভা তথা বর্তমান সরকারের। আমাদের সংবিধানে মন্ত্রীদের যৌথ জবাবদিহির বিধান রয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই জবাবদিহি আদায় করার মতো সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ দেশে নেই আর।
কিন্তু তারপরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারের সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই দেশের মালিকানা কোনো সরকার বা সংসদের নয়। এ দেশের মালিকানা জনগণের। এই জনগণের ভোটাধিকার ও মৌলিক অধিকারকে সম্মান না করে ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রকাশ্যে কোনো দেশের সাহায্য চাওয়া এবং এ জন্য ‘যা যা দরকার’ অবাধভাবে তা করার আহ্বান জানানো ধৃষ্টতার শামিল।
কোনো সরকারের মন্ত্রীকে এই ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ দেশ স্বাধীন করেনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত আমাদের আদি সংবিধানে এমন কোনো অনুমোদনও কাউকে দেওয়া হয়নি।
# আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। সাউথ এশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের সাবেক ব্যুরো সদস্য।